
কিছুদিন আগে ভারতের ইটিভি নামের একটি টিভি চ্যানেলের একজন সাংবাদিক এসেছিলেন আমার সাক্ষাৎকার নিতে। সাক্ষাৎকালে আমাকে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সাহিত্য সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন সেই রিপোর্টার। তার প্রশ্নমালার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিলো যে, একজন বিরোধী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আসন্ন সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমি কতটা আশাবাদী এবং বাংলাদেশে বিরাজমান পরিসি'তিতে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব কিনা। আমি এ প্রশ্নের ব্যাপারে এক সেকেন্ড চিন-া না করেই বলেছিলাম যে, বাংলাদেশে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী এবং সম্মেলন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশ অবশ্যই আমাদের দেশে বিরাজ করছে। আমরা ঐতিহ্যগতভাবেই অতিথিপরায়ণ। অতিথির অভ্যর্থনা, যথাযথ সম্মান প্রদর্শন, তাদের নিরাপত্তা বিধান এবং স্বচ্ছন্দ অবস'ান নিশ্চিত করতে দেশের জনগণ ও সরকার সর্বতোভাবে নিবেদিত। দেশের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে ছোটখাটো ঘটনার অবতারণা হয়ে থাকে। সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমাদের মেহমানদারিতে তার সামান্য প্রভাব পড়বে না। সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ। আর সার্কের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে এই সংস'ার সাফল্য, আরো কার্যকারিতা এবং সঠিক সময়ে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া আমি একান-ভাবে প্রত্যাশা করি।
আমার উত্তর শুনে ইটিভির সেই সাংবাদিক উৎফুল্লভাবে মন-ব্য করলেন যে- আমি নাকি রাষ্ট্রনায়কোচিত জবাব দিয়েছি। এই প্রশংসায় আমি বিগলিত হইনি। কারণ আমি যা বিশ্বাস করি সেটাই বলেছি। সাংবাদিক আমাকে জানালেন যে, তিনি বাংলাদেশে এসে আরো কয়েকজন বিরোধী রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। এবং তাদের কাছেও এই প্রশ্নটি তিনি করেছেন। তারা নাকি এর উত্তরে বলেছেন- যেখানে আমাদের নিজেদের কোনো নিরাপত্তা নেই- সেখানে বিদেশী মেহমান এলে তাদের নিরাপত্তা দেবে কে? সুতরাং সার্ক সম্মেলন হওয়া নাকি সম্ভব নয়। আমি জানি না, কোন রাজনৈতিক নেতা এ ধরনের মন-ব্য করেছেন। যিনি বা যারা এই মন-ব্য করেছেন তাদের নামও আমি শুনতে চাইনি। আমি বলবো, যদি কেউ সত্যিই এ ধরনের মন-ব্য করে থাকেন, তাহলে তিনি জাতীয় স্বার্থের প্রতিকূলে কথা বলেছেন। ঢাকায় সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের বিষয়টি আমাদের জাতীয় সম্মানের ব্যাপার। এখানে বিশেষ কোনো ব্যক্তির সম্মান বড় নয়- মুখ্য হলো দেশের বিষয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় সার্কের ত্রয়োদশতম সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ছিলো। কিন' দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে- বাংলাদেশে নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করলে সম্মেলন স'গিত হয়ে যায়। সার্ক সম্মেলন স'গিত হওয়ায় আমি ভীষণভাবে মর্মাহত হয়েছিলাম।
১৯৮৫ সালের ৭ ডিসেম্বর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস'ার যে যাত্রা শুরু হয় তার মাধ্যমে এ উপমহাদেশে সহযোগিতার নতুন আশার আলো প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিলো। আর সে আলোর মশাল প্রথম আমিই হাতে তুলে নিয়েছিলাম। আবার ঢাকায় সেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে এবং এ উপমহাদেশের ৭টি দেশের মধ্যে ঐক্য আরো সুদৃঢ় করার নেতৃত্ব বাংলাদেশের হাতে আসবে- সে অনুভূতি আমাকে আনন্দে উদ্বেলিত করে তুলেছিলো। সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার কথা মনে পড়লেই স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে অনেক গৌরবের কাহিনী। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে ৭টি দেশের পথ ভ্রমণ করে আবার সার্ক ঢাকায় ফিরে আসবে- এই অনুভূতি আমাকে মোহবিষ্ট করে তোলে। কারণ এখানে আমার আনন্দ-উচ্ছ্বাস-উদ্বেলতা, হৃদয়ের মধুর শিহরণ এবং প্রাণের স্পন্দন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। তাই ফেব্রুয়ারিতে যখন ঢাকায় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স'গিত হয়ে যায়- তখন আমি দারুণভাবে ব্যথিত হয়েছিলাম। তারপরও আশাবাদী ছিলাম- আগামী কোনো এক সময়ে ঢাকায় সার্ক সম্মেলন অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে। আশা করি ঘোষিত তারিখে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সফলভাবে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ইনশাল্লাহ। সার্কের সাথে যেনো আমার আত্মার গভীর সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। কারণ এটা আমার শাসনামলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক ঘটনা। এ উপমহাদেশের ৭টি দেশের মধ্যে প্রথম ঐক্য ও একতার বন্ধন সূচিত হয়েছিলো এই সার্কের মাধ্যমে। জাতীয় চিন-া-চেতনার বাইরেও আমি ব্যক্তিগতভাবে সার্কের দৃঢ় পায়ে অব্যাহত পথচলা কামনা করি এ কারণেও যে, আমি এই সংস'ার প্রথম চেয়ারম্যান। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণে ইতিহাসকে মুছে ফেলা বা ঐতিহাসিক ঘটনাকে এড়িয়ে যাবার প্রবণতা আছে। তবে সার্ক যদি টিকে থাকে- তাহলে আমি যে এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলাম এই সত্যকে কেউ ঢেকে রাখতে পারবে না। তাই আমি সর্বদা সর্বান-করণে সার্কের সাফল্য কামনা করি।
দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যপীড়িত, জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া, অনগ্রসরতার যাঁতাকলে পিষ্ট এবং অপরদিকে বহু ধর্ম, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির ধারক-বাহক ৭টি দেশকে নিয়ে গঠিত অঞ্চলে সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের অঙ্গীকার নিয়ে জোট গঠন ছিলো এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আমি সেই ইতিহাসের এক সাক্ষী, সংগঠক এবং এক চরিত্র। এই ইতিহাস সৃষ্টি করতে গিয়ে আমাকে কতো অক্লান- পরিশ্রম করতে হয়েছে, কিংবা কতোটা সুনিপুণভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হয়েছে- তা আমার স্মৃতিপট থেকে এখনো বিলীন হয়ে যায়নি। যতোদিন সার্ক টিকে থাকবে, ততোদিন ইতিহাস সমস্বরে ঘোষণা করবে- ঢাকা সার্কের সূতিকাগার, আমি সার্কের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। অনেক বাধা-বিপত্তি পার হয়ে আবার ঢাকায় সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেখে আমি নতুনভাবে আশান্বিত হয়ে উঠেছি। আজো মনে পড়ে- সার্কের জন্ম উপলক্ষে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠা সেই কবিতাটি এখানে উল্লেখ করে আমার সে দিনের অনুভূতিটা পাঠকের কাছে উপস'াপন করতে চাই।
“মহান লক্ষ্যের সম্মুখে যে স্বপ্নের বিস-ার
সাতটি সম্ভাবনার সৌরভ দক্ষিণ এশিয়ার
বিশ্বাসে প্রতিফলিত এবং মিলিত এখন
সম্মানে, জীবনের গানে আর ফসলের ঘ্রাণে।
পাহাড়, সমুদ্র, নদী, রংধনু দৃশ্যের দ্বীপে
সূর্যের পটভূমি তো এখনো মিথ্যে নয়
শানি- অগ্রগতির ঝাঁক আসবে আলোতে
পৃথিবীর এই অংশের অন্ধকার সরাতে।
সহযোগিতা ক্রমেই যদি সহজতর হয়
পারস্পরিক আদান-প্রদানে বন্ধুর বন্ধন
এবং প্রশস- প্রগতির পথে সংঘবদ্ধ শপথ
প্রসারিত হবেই একদিন ভাগ্যকে ঘোরাতে।
সভ্যতার ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরব
খুঁজে পাবে উন্নত জীবন ঝংকার,
পরিচিত পদক্ষেপ হবে পুষ্পিত আবার,
আকুল আগ্রহে জীবন গড়ে তুলবার।”
এই সার্কের ত্রয়োদশ সম্মেলনকে সামনে রেখে স্মৃতির দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে প্রথম সম্মেলনের অন্য ৬ জন সম্মানীত নেতার কথা। সেই প্রথম সম্মেলনে ভারত থেকে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, পাকিস-ান থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, শ্রীলংকা থেকে প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস জয়বর্ধনে, নেপাল থেকে রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ্ দেব, ভুটান থেকে রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক এবং মালদ্বীপ থেকে এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুম। প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সাত দেশের সাত নেতার মধ্যে চারজনই বেঁচে নেই। এই চারজনের তিনজনই দুঃখজনক মৃত্যুবরণ করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, পাকিস-ানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এবং নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ্ দেব নিহত হয়েছেন। তাঁদের স্মৃতি আমাকে আজো কাঁদায়। স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস জয়বর্ধনে। প্রথম অংশগ্রহণকারী সাত নেতার মধ্যে বেঁচে আছি আমি সার্কের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুম এবং ভুটানের রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক। প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম এবারের সম্মেলনেও যোগদান করছেন। তিনি ভাগ্যবান- এ পর্যন- অনুষ্ঠিত সবক’টি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। ভুটানের রাজা গত ফেব্রুয়ারিতে যে সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ছিলো সেখানে যোগ দিতেন না। এবার তিনি আসবেন কিনা তা এখনো নিশ্চিত জানি না। আমি সার্কের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে এবারের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সময় কতোটুকু সম্মান পাবো জানি না- ইতিহাসের প্রতি সম্মান দেখানোর প্রবণতা আমাদের দেশে নেই বললেই তো চলে।
সার্ক প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে। সার্কের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকায়। এটা ছিলো দেশের জন্য গৌরবের। এই সম্মেলন প্রথমবারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে- সেটাই শুধু গৌরবের কারণ ছিলো না- ওই বৈঠকে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জাতিসমূহকে তাদের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য ও বিভক্তির অবসান ঘটিয়ে আগামী দিনের সমস্যা মোকাবেলা করার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হয়েছে। সাতটি দেশের সাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছানোর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালোনোর রাজনৈতিক সংকল্প গ্রহণ করেছিলাম আমরা সাত নেতা। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম প্রথম সার্ক চেয়ারম্যান, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার নেতা। অথচ সেই আমাকেই রাজনৈতিক কারণে জেলে পাঠানো হয়েছিলো। এ অঞ্চলের নেতৃত্বের মর্যাদার কথাও বিবেচনা করা হয়নি। যা হোক, আমি আমার কষ্টের কথা ভুলে গেছি- ভুলে যেতেও চাই। তবুও বলতে হয়- দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে, সার্কের প্রথম চেয়ারম্যানকে কারারুদ্ধ করায় জাতি কতো কি অর্জন করেছে কিংবা হারিয়েছে- সে বিচার একদিন জনগণই করবে। সার্কের প্রথম চেয়ারম্যানকে ত্রয়োদশ সম্মেলনে কীভাবে স্মরণ করা হয়- সেটাই এখন দেখার বিষয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সার্কের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন- আমি তাঁর সাফল্য কামনা করি। একান-ভাবে আশা করি- তিনি তাঁর দূরদর্শিতা দিয়ে সার্ককে আরো কার্যকর করে তুলতে পারবেন। সার্কের প্রবক্তা বাংলাদেশের মান-মর্যাদা ও নেতৃত্ব তিনি আরো ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
ইতিহাসে যার যে অবস'ান, যার যে অবদান- আমি তা সব সময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। সার্ক প্রস-াব উত্থাপন করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালের মে মাসে। তিনি সার্কের স্বপ্ন দেখেছিলেন এটা যেমন সত্য, তার বাস-ব রূপ দিয়েছিলাম আমি এটাও সত্য। কিন' এই সত্যকে অনুচ্চারিত রাখা হয়। সার্কের প্রস-াব উত্থাপনের পর এটা বাস-বায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছিলো আমাকেই। ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে নয়াদিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ‘দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা ঘোষণা’ গৃহীত হয় এবং ৯টি নির্বাচিত ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার আন-র্জাতিক কার্যক্রম চালু করা হয়। শেষ পর্যন- থিম্পুতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৮৫ সালের ৭ ও ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় সার্কের প্রথম শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান- গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আন-র্জাতিক পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলো ঢাকায় সার্কের প্রথম শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠান। গোটা জাতির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিলো নতুন প্রেরণা। তখন আন-র্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল হয়েছিলো। কিন' দুঃখের কথা হলো আজ যারা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে সার্কের স্বপ্নপুরুষ অভিহিত করে সার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য গর্ববোধ করেন, সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রার প্রাক্কালে তাদের মধ্যে কিন' আনন্দ-উল্লাস পরিলক্ষিত হয়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়া যে প্রস-াবের উত্থাপন করেছিলেন, আমি তার সফল বাস-বায়ন ঘটিয়েছিলাম- এটাই আমার সফলতা। আমি বলি না যে- সার্ক একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। আমার উদ্যোগে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তাই এই কৃতিত্বটুকু আমার ভাগ্যে জুটেছে। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা-আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে স্বাধীনতা এসেছে। সেই পথ চলার মধ্যে যথার্থ সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে। এই কৃতিত্ব থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা যায় না। সার্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমার ওপরও কিছু কৃতিত্ব এসেছে সময়ের সিঁড়ি বেয়ে। সার্কের মূল চেতনা ও লক্ষ্য যদি বাস-বায়িত হয়, তাতে আমি যে কতো আনন্দিত হবো- সে কথা ব্যক্ত করতে পারবো না। কারণ, এটা ছিলো আমার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য।
আমরা যখন সার্ক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তখনকার প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপটের মধ্যে কিছুটা তারতম্য দেখা দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। তখন আমাদের এ অঞ্চলের সামনে বড় সমস্যা ছিলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। ১৯৮৫ সালে সার্কভুক্ত ৭টি দেশের মোট জনসংখ্যা ছিলো ৯৩ কোটি ৬২ লাখ। বর্তমানে সে জনসংখ্যা ১৩৬ কোটি। তবে ১৯৮৫ সালের আগে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার ছিলো- পরবর্তী পর্যায়ে সে হার গড়ে কমে এসেছে। তখন বিশ্বব্যাংকের যে হিসাব ছিলো তাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলে এ অঞ্চলের জনসংখ্যা দেড়শ’ কোটিরও ওপরে চলে যেতো। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিলো ১০ কোটি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ২.৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে সেই হার অব্যাহত থাকলে দুই হাজার সালেই বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৭০ লাখে উন্নীত হয়ে যেতো। বিজ্ঞ পাঠকবৃন্দের হয়তো মনে থাকবে যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের জন্য আমি জাতিসংঘ পুরস্কার লাভ করেছিলাম। সার্ক অঞ্চলের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচির কারণে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অকল্পনীয় পর্যায়ে কমে এসেছিলো। সে কারণেই দুই হাজার সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটিতে পৌঁছায়নি। ২০০৪ সালে এসে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার শাসনামলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ করার ব্যবস'া গ্রহণ করেছিলাম। শুধু বিনামূল্যে বিতরণই নয়, পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। কিন' ১৯৯০ সালের পর আমার গৃহীত পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর চড়া মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেড়ে গেছে। আমার শাসনামলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম তা অব্যাহত থাকলে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১২ কোটির ওপরে যেতো না।
সার্ক যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ ছিলো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে দ্বিতীয় স'ানে। ৮ কোটি ৮১ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে পাকিস-ান ছিলো তৃতীয়। তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ২.৮ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হিসাব মতে দুই হাজার সালে পাকিস-ানের জনসংখ্যা ১৪ কোটিতে উন্নীত হবার কথা ছিলো। পাকিস-ান জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা ১৫ কোটি। সে হিসেবে আমাদের উন্নতি হয়েছে। জনসংখ্যায় আমাদের দ্বিতীয় স'ান পাকিস-ান দখল করেছে। তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে পাকিস-ান আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। পাকিস-ানে বর্তমানে মাথাপিছু আয় ৪৪৫ মার্কিন ডলার এবং জিডিপি ২৮২ বিলিয়ন ডলার। সেখানে বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু আয় ৪০০ ডলার এবং জিডিপির পরিমাণ ১৮৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ এমনটি হবার কথা ছিলো না। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে, দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ বিনষ্ট না হলে, একের পর এক শিল্প-কারখানা বন্ধ না হলে, কিংবা দেশ বিদেশী পণ্যের বাজার না হলে আমাদের মাথাপিছু আয় এবং ডিজিপি অনেক বেড়ে যেতো।
বিশ্বে অনেক বিষয়েই অনেক শীর্ষ বৈঠক হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন' আমাদের অঞ্চলে এ ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠানের নজির ইতিপূর্বে ছিলো না। সে দিক থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ বৈঠকটি ছিলো অনেক দৃষ্টিকোণ থেকেই এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, পাকিস-ান, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মধ্যে অনেক বিষয়েই অনৈক্য ও ঐহিত্যগত ভিন্নতা ছিলো এবং এখনো আছে। কিন' তা সত্ত্বেও আমরা অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। এই ৭ দেশের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে। আন-র্জাতিক প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাও আছে। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের সময় অর্থাৎ ইরাক সেনা অভিযান চালিয়ে কুয়েত দখল করে নেবার পর সৃষ্ট পরিসি'তিতে আমি ইরাকের বিরুদ্ধে সৌদি আরবে সৈন্য প্রেরণ করেছিলাম। প্রতিবেশী ভারত আমার নীতিতে একমত ছিলো না। তা সত্ত্বেও সার্কের ইস্যুতে আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। সার্ক প্রতিষ্ঠার আগেও জাতিসংঘের মঞ্চে আমাদের ৭ দেশ সব সময় অভিন্ন কন্ঠে কথা বলেনি। আসিয়ান বা ইইসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যে রাজনৈতিক সমঝোতা বিদ্যমান ছিলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তা ছিলো না। তা সত্ত্বেও আমরা শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হতে পেরেছিলাম এবং একটা কার্যকর সিদ্ধান- গ্রহণ করতে পেরেছি। আমরা সার্কের অধীনে সহযোগিতার যেসব ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করেছিলাম- তার মধ্যে ছিলো শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, স্বাস'্য ও জনসংখ্যা কার্যক্রম, ক্রীড়া, কৃষি ও বনজ সম্পদ, শিল্প ও সংস্কৃতি, আবহাওয়া, টেলিযোগাযোগ, পর্যটন, পল্লী-উন্নয়ন, পরিবহন, মাদকদ্রব্যের চোরাচালান ও মাদকের অপব্যবহার প্রতিরোধ, উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা পালন ইত্যাদি।
আমরা সার্কের আওতায় যে নীতিসমূহ গ্রহণ করেছিলাম- সে স্মৃতিগুলো এখনো আমার স্মৃতির দৃশ্যপটে ভাস্বর হয়ে আছে। আমরা যে নীতি প্রণয়ন করেছিলাম, তার মধ্যে ছিলো এ অঞ্চলের প্রায় শতকোটি মানুষের উন্নয়নের প্রচেষ্টা। এখন সার্কের আওতায় আছে ১৩৫ কোটি মানুষের বাস। সার্কের নীতি হচ্ছে সদস্য দেশগুলো কেউই পরস্পরের অভ্যন-রীণ ব্যাপারে হস-ক্ষেপ করবে না এবং পরস্পরের সার্বভৌমত্ব মেনে চলবে। এর মধ্যে তারা পারস্পরিক মৈত্রী গড়ে তুলবে এবং নির্ধারিত ক্ষেত্রে অপরকে সাহায্য করার নীতি পালন করবে। তাই সার্কের নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিলো- প্রথমত সার্ক অন-র্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতা কল্যাণকর হবে সেই বিশ্বাস, দ্বিতীয়ত জাতিসংঘ ও জোটনিরপেক্ষ সংস'াগুলোর সনদের নীতিতে অবিচল থেকে এ অঞ্চলের শানি- ও সি'তিশীলতার উন্নয়ন কামনা এবং তৃতীয়ত সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বাধীনতা, অখণ্ডতা, অন্যের অভ্যন-রীণ ব্যাপারে হস-ক্ষেপ না করা, শক্তি প্রয়োগ না করা এবং শানি-পূর্ণ উপায়ে সকল বিরোধ মীমাংসার নীতি উজ্জীবিত ও সমর্র্থন করা। আমরা ঢাকা ঘোষণায় যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম সেগুলো ছিলো- পারমাণবিক অস্ত্ররোধ, স্বল্পোন্নত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, মুদ্রা ও লগ্নির প্রশ্নে আন-র্জাতিক বৈঠক আহ্বান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে সম্পূরক অর্থনীতি, জাতীয় ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং আত্মনির্ভরশীলতার তাগিদ। তখন বিশ্বের মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষের সংস'ার পক্ষ থেকে ঢাকা ঘোষণা এক অনন্য ঘোষণার মর্যাদা লাভ করেছিলো। সেই অনুভূতি আজো আমাকে আন্দোলিত করে। সেই ঘোষণা লিপিবদ্ধ হয়েছিলো চৌদ্দটি অনুচ্ছেদে। আমরা সার্কের ৭ নেতা একযোগে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম যে, নবগঠিত সার্ক আঞ্চলিক সহযোগিতা দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে, দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে এবং শানি- ও সমষ্টিগত আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমার মনে পড়ে সার্কের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে একজন সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি বাংলাদেশের স্বার্থ বেশি করে দেখবেন, না সার্কের স্বার্থ দেখবেন বেশি? উত্তরে আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি বাংলাদেশের স্বার্থই বড় করে দেখবো। আবার সার্কের চেয়ারম্যান হিসেবে সদস্য সাতটি দেশের স্বার্থই দেখবো।
যে সহযোগিতার দ্বার আমরা উন্মোচন করেছিলাম সে পথ যে কুসুমাস-ীর্ণ ছিলো তাও নয়। বৈচিত্র্যের পটভূমিতে দারিদ্র্য জয়ের অভিন্ন তাগিদ দক্ষিণ এশিয়ায় অবশ্যই ছিলো। কিন' পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধও কম ছিলো না। প্রথম সার্ক সম্মেলনের পূর্বে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বন্দ্ব-বিরোধের কথা এখানে আর উল্লেখ করতে চাই না। তবে এটুকু বলা প্রয়োজন যে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা অবশ্যই ছিলো এবং সেসব সমস্যা দক্ষিণ এশিয়ার আকাশকে বারবার মেঘাচ্ছন্ন করেছে। আন-র্জাতিক কমিটমেন্ট থেকে শুরু করে অভ্যন-রীণ সমাজ ব্যবস'া পর্যন- বহু ক্ষেত্রে সাত দেশের মধ্যে ভিন্নতা ছিলো। তখন পুরনো এবং নতুন উভয় ধরনের বৈরিতা ছিলো। আবার নতুন-পুরনো মৈত্রীবন্ধনও ছিলো। তখন অনেক বৈরী বা বিরোধী ভাবনা পেছনে রেখেই সার্ক গঠিত হয়েছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গের এ অঞ্চলে আর একটি হিমালয় জয়ের মতো সাফল্য আমরা অর্জন করেছিলাম সার্ক নিয়ে যাত্রা শুরু করার মাধ্যমে।
কবিতার উষ্ণ স্পন্দনে মোহিত হয়ে আমরা সমাপ্তি টেনেছিলাম ঐতিহাসিক প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের অধিবেশন। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জয়বর্ধনে তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণ ইংরেজিতে উদ্ধৃত করেছিলেন। এ অধিবেশনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা- “বাংলার মাটি বাংলার জল” ইংরেজিতে পাঠ করেছিলেন। সমাপ্তি অধিবেশনে রাজীব গান্ধী বাংলা উচ্চারণে পাঠ করেছিলেন- আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের “চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজেমাদল” কবিতার চারটি লাইন। তিনি বলেছিলেন, আজকের এই শীর্ষ সম্মেলন আমাদের সাত জাতির জন্য এক নতুন প্রভাতের সূচনা করবে। তাই কবি কাজী নজরুলের কবিতার কথা স্মরণ করি- “ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/আমরা আনিব রাঙা প্রভাত/ আমরা টুটাবো তিমির রাত/ বাধার বিন্দ্যাচল।” রাজীব গান্ধীর সেই বিশেষ উচ্চারণভঙ্গি এখনো আমার মনে ঝঙ্কারিত হয়। তার করুণ মৃত্যুর ঘটনা এখানো আমাকে ভারাক্রান- করে তোলে। সার্কের এই সমাপ্তি অধিবেশন দিনের সকাল বেলা আমার মনেও একটি কবিতার জন্ম হয়েছিলো। সেই নতুন প্রভাতে লেখা কবিতাটি আমি সমাপ্তি অধিবেশনে পাঠ করেছিলাম। সে কবিতাটিও এই স্মৃতি মন'নের মাঝে উল্লেখ করতে চাই।
“একশো কোটি মানুষের উষ্ণ স্পন্দনে
ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা নিবিড় বন্ধনে
স্বপ্ন সার্থক হলো সাতটি দেশে
শপথ সত্য হলো সহযোগিতায় এসে।
সূর্যের আলোতে আজ সাতটি পতাকা
আশা-ভরা আঙ্গিনায় জ্বল জ্বল উড়ছে
বিশ্বাস আমাদের আর রূপ কথা নয়
সমঝোতার মধ্যে জীবন সঞ্চারিত হয়।
পৃথিবীর উৎসুক চোখ আমাদের কাছে
প্রমাণ করেছি আমরা মিলনের মাঝে
ইচ্ছা যদি থাকে ভ্রাতৃত্ব বাড়ানোর
পথ হয়েই যায় সম্মতি সংগ্রহের
অসংখ্য মানুষের দুয়ারে আমাদের
পৌঁছে দিতে হবে উন্নত জীবন
দূর করে দিতে হবে দুঃখ দারিদ্র্য
করতে হবে শিক্ষার সুযোগ আরো ব্যাপ্ত
মিলে মিশে প্রতিনিয়ত পরস্পরকে ভালোবেসে।”
গত ২০ বছরে এই অঞ্চলের মধ্যে আরো অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং আজকের প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি- সার্কের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো আরো সমপ্রসারণের প্রয়োজন আছে। সার্ক প্রতিষ্ঠার সময়ে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সন্ত্রাসের অসি-ত্ব ছিলো না। কয়েকটি দেশের ভেতর রাজনৈতিক কারণে গোলযোগ বা কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ ছিলো। কিন' সামাজিক সন্ত্রাস ছিলা না। এখন বাংলাদেশের মতো প্রায় সব দেশের মধ্যেই কমবেশি সামাজিক সন্ত্রাস আছে। সন্ত্রাসীরা অপরাধ করে পালিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ঢুকে পড়ছে। এসব সন্ত্রাসী আটক করা এবং তাদের সংশ্লিষ্ট দেশের প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়ার ব্যবস'া গ্রহণের প্রয়োজন আছে। কোনো দেশের সন্ত্রাসী বা অপরাধী প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়ে যাতে রক্ষা না পায় সে ব্যাপারে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। এ অঞ্চলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সার্কের ভূমিকা থাকলে কার্যকর ফল পাওয়া যেতে পারে। নদী শাসন, বাঁধের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক গতি থামিয়ে দেয়া হলে পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হবেই। এ ব্যাপারে সার্ক কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। সার্ক অন-র্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াতের জন্য ভিসা ব্যবস'া সহজ ও শিথিল করার প্রয়োজন আছে। আমরা যে ৭টি দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করেছি- সাধারণ মানুষ যেনো তা অনুভব করতে পারে। সার্কের দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য সৃষ্টির একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এ ধরনের আরো কিছু অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় সার্কের আওতায় নিয়ে এলে এই সংস'ার গুরুত্ব, কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা আরো প্রসারিত হবে।