
আমি যতটা ভাবি ততটা লিখি না। কারণ সময়ের অভাব। তাই লেখার বিষয় মাথায় জমা থাকলেও লেখা হয় না। সার্বক্ষণিক রাজনীতিক হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক চিন-ার মধ্যেই ডুবে থাকতে হয়। আবার আমি কোনো নিয়মিত লেখকও নই। মাঝে মধ্যে যেটুকু লিখি তার সবাই আমার রাজনৈতিক চিন-া-চেতনা, মতাদর্শ ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। এর বাইরে আপাতত যেতেও চাই না। সমপ্রতি দক্ষিণবঙ্গে আমার একটি রাজনৈতিক সফর ছিলো। সেই সফরের সফলতার বাইরেও একটা চমৎকার অনুভূতি ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে। জোছনা রাতে নৌ-যাত্রার অভিজ্ঞতা খুবই ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে- মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ‘দুরন- প্রত্যয়’ শিরোনামের একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটি দৈনিক ইনকিলাবের একুশের ফেব্রুয়ারির বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। তার আট দিন পর ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই মহাসমাবেশকে সামনে রেখে আমি বেশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। মহাসমাবেশের ডাকে কী রকম সাড়া পাবো- সারা দেশ থেকে কত লোক আসবে এবং যারা আসবে তাদের কাছে আমার বার্তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়ে কিছুটা উৎকণ্ঠুার মধ্যে ছিলাম। কিন' পয়লা মার্চ- ২০০৬ তারিখে পল্টনে আমার আশাতীত রাজনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন একটি জোটের মহাসমাবেশ, অতঃপর সরকারি দল এবং তারপর সরকারি জোটের আর একটি শরিক দলের মহাসমাবেশের পর জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশটি ছিলো বর্তমান রাজনৈতিক ধারা-প্রবাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
দেশের মানুষের কাছে আমরা কতটা আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছি- তার বার্তা পেয়েছি পল্টনের মহাসমাবেশ থেকে। এটা ছিলো আমার বিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গনে সর্বাধিক সাফল্যের কর্মসূচি। এখানে জনতার সাথে আমি একাত্ম হতে পেরেছি। জনতাও আমার সাথে একাত্ম হয়েছে। আমি রাজনীতি করি জনগণের স্বার্থে। কারো ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়। জনগণ আমার কাছে যা প্রত্যাশা করে- আমার রাজনীতিতে যদি তার প্রতিফলন না ঘটে- তাহলে সেই রাজনীতি মূল্যহীন। পরিণত বয়সে আমি মূল্যহীন রাজনীতি করতে পারি না। আমি একান-ভাবে লক্ষ্য করেছি- আমার বক্তব্যে জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। মহাসমাবেশে কোনো ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারে আমার সামনে তিনটি পথ খোলা ছিলো। আমি গত তিন মাস ধরে সেই তিন পথ নিয়ে গভীর চিন-া করেছি। জনগণের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছি। কয়েকটা জেলায় সফরও করেছি। তারপর মহাসমাবেশে যখন আমার বেছে নেয়া পথের ঘোষণা দিলাম- তখন সত্যিকার অর্থে ‘জনতার সাগরে জেগেছে উর্মী’ বলতে যা বুঝায় তাই ঘটলো। আমার হৃদয় ভরে গেলো। ভবিষ্যতে ভাগ্যে কী ঘটবে কী ঘটবে না- সে চিন-া আমার মন থেকে চিরতরে মুছে গেলো। নিজেকে তখন সার্থক মনে করেছি- জনগণের মনের কথা বলতে পেরেছিলাম বলে। তিনটি মহাসমাবেশকে ছাপিয়ে আমার মহাসমাবেশ জনারণ্যে পরিণত হয়েছে- মানুষ আমার বার্তা গ্রহণ করেছে- মানুষের মনোভাব আমি জানতে পেরেছি- এই বহুমুখী অর্জন আমাকে রাজনীতিতে সফল করে তুলেছে।
আমি তো সর্বদাই কিছু না কিছু বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হই। আমার রাজনীতির মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও বিভ্রানি-কর প্রচারের জটাজালে আমাকে আটকানোর একটা প্রবণতা আছেই। মহাসমাবেশের সুস্পষ্ট ঘোষণার পরও একটি পত্রিকায় আমার মন বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার ঘোষণায় জনতার প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটলেও হয়তো দুই পক্ষই খুশি হতে পারেনি। একটা ধারণা আছে যে- বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমি সরকারি বা বিরোধী জোটের যে পক্ষই অবলম্বন করবো সেই পক্ষের ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়া নিশ্চিত হয়। কিন' সেই প্রত্যাশার যদি ব্যাঘাত ঘটে- তাহলে উভয় পক্ষেরই আমার উপর ক্ষুব্ধ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন' আমি জনতার কাতারই বেছে নিয়েছি। এখানে যদি স্বার্থের রাজনীতির কাছে হেরেও যাই- তথাপিও আমার সান-্বনা থাকবে- জনগণের মনোজগত আমি জয় করেছি। আমি আগেও বলেছি এখানো বলছি- কারো ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা আমার রাজনীতির আদর্শ নয়। ‘আমার দেশ’ পত্রিকা লিখেছে- ‘আমার ঘোষণায় নাকি জাপার মধ্যকার বিএনপিপন'ী অংশটি হতাশ হয়েছে।’ এই লেখায় আরো কিছুটা বিভ্রান- করা হয়েছে যে, আমি নাকি বিএনপি’র তীব্র সমালোচনা করেছি। আরো বলা হয়েছে- আমার বক্তব্যের মধ্যে নাকি বিরোধী জোটের প্রতিই কিছুটা ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত আছে। এসব ধারণা বা কল্পনা-আশ্রিত মন-ব্য সম্পর্কে কোনো ধরনের অভিমত প্রকাশের কিছু নেই। যেহেতু আমি পল্টনে সুস্পষ্টভাবে আমার বক্তব্য প্রকাশ করেছি। হয়তো আমার পুরো বক্তব্য সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছেনি। তাই পল্টনে যা বলেছি- সে কথা জনগণের কাছে আবার তুলে ধরতে চাই। সে উদ্দেশ্যেই এই ভূমিকার অবতারণা করেছি।
সেদিন পল্টনে আমি যা বলেছি : ঐতিহাসিক পল্টনের মহাসমাবেশে মানুষের বাঁধ ভাঙা জোয়ার দেখে আমার হৃদয় এক দিক আনন্দে কানায় কানায় ভরে ওঠে- আবার আরেক দিক বেদনায় ভারাক্রান- হয়ে যায়। কেনো এই অনুভূতি সে কথাই আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আমাকে বলা হয়েছে স্বৈরাচারী, গণআন্দোলনের মুখে নাকি আমি পদত্যাগ করেছি। আমি স্বৈরাচারী হলে আমার ডাকে এক জনসমুদ্রের সৃষ্টি হতো না। জনতা প্রমাণ করেছে, আমি স্বৈরাচারী নই- আমি তাদের প্রাণের একান- ভালোবাসার মানুষ। তাই আমার হৃদয় আজ আনন্দে নেচে ওঠে। মুসলিম শরিফের হাদিসে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছেন, যদি কেউ কাউকে ভিত্তিহীন গালি দেয়, আর সে তার উপযুক্ত না হয়, তাহলে সে গালি তার উপরই ফিরে আসে। আল্লাহর ইশারা ছাড়া নবী কোনো কথা বলেন না। তাই রাসূলের কথা চিরসত্য প্রমাণিত হয়েছে। একদিন যারা আমাকে স্বৈরাচার বলে গালি দিয়েছিলো, আজ তারাই একে অপরকে স্বৈরাচার বলছে।
আবার ভারাক্রান- কেনো হই? গণতন্ত্র আর জনগণের শানি-র আশায় স্বেচ্ছায় আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিলাম। আজ দুঃখ হয়- যে জনগণের স্বার্থের কথা চিন-া করে শানি-র জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দিলাম- সেই জনগণ এখন সীমাহীন দুঃখের অকূল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাদের দুর্দশার ছবি এই জনতার মুখে আমি দেখতে পাই। তাই আমার হৃদয় ভারাক্রান- হয়ে ওঠে। আমি আরো শোকাহত যে, গত কয়েক দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় দু’টি গার্মেন্টস দুর্ঘটনায় শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছে। আমি তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা, তাদের পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন এবং নিহতদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের আহ্বান জানাই।
আমি যখন মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছি- তখন বলেছিলাম, জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র এক বছর বাকি। গত নির্বাচন থেকে দেশে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কোনো দল বা জোটের সাথে জোটগতভাবে নির্বাচন করবে নাকি এককভাবে নির্বাচন করবে সে ব্যাপারে আমি মহাসমাবেশে ঘোষণা করবো। আমি বলেছিলাম- শুধু ক্ষমতায় যাবার জন্যই জোটে যাওয়া নয়, জোট হতে পারে জনগণের স্বার্থে প্রণীত কর্মসূচির ভিত্তিতে। তার জন্য আমরা সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে- এমন ১২ দফা কর্মসূচি পেশ করেছি। আমি বলেছি এই কর্মসূচি যারা মেনে নেবেন- এবং যাদের কর্মসূচি আমরাও গ্রহণ করতে পারবো কেবল তাদের সাথেই আমরা জোট গঠন করতে পারি। আজ সে ব্যাপারে ঘোষণা দেয়ার সময় এসেছে। ইতিমধ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক পালাবদল হয়েছে। তাই আমার সেই ঘোষণা দেয়ার আগে দেশের সার্বিক পরিসি'তি এবং রাজনীতির অবস'া সম্পর্কে আমি আপনাদের সামনে কিছু কথা বলতে চাই।
দেশ আজ বিভিন্ন ধরনের সংকটে নিমজ্জিত। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোনো দেশে এত সংকট একসাথে আসেনি। ডিজেল, সার, বিদ্যুৎ সংকটের ফলে দেশ অচল হয়ে পড়েছে। মানুষ এখন দিশেহারা। বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রায় সময় অন্ধকারে ডুবে থাকতে হয়। বিদ্যুতের জন্য কানসাটে ২০ জন সাধারণ মানুষ জীবন দেয়ার পরও বিদ্যুৎ সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। গত চার বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের একমাত্র সাফল্য- টঙ্গীর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও বন্ধ হয়ে রয়েছে। প্রতিদিন ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং। এসএসসি পরীক্ষার সামনে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ছাত্র-ছাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এক মন্ত্রী বললেন, তিনি ১১শ’ কিলোমিটার ভ্রমণ করে এসেছেন কিন' কোথাও ডিজেল সংকট দেখেননি। অথচ ডিজেলের অভাবে ট্রেন চলে না, সেচ বন্ধ-কৃষি কাজ চলে না। অর্থমন্ত্রী বললেন- বিশ্বে তেলের দাম বেড়েছে। তাই ডিজেলের দাম বাড়াতে হবে। মন্ত্রীর কথা শোনার পর বাজার থেকে ডিজেল উধাও হয়ে গেলো। সেই তেল নিয়ে সংকট এখনো কাটেনি- সংকট কাটার লক্ষণও দেখা যায় না। ফলে আসন্ন মৌসুমে চাষাবাদ দারুণভাবে ব্যাহত হবার আশংকা দেখা দিয়েছে। যে দেশে তেলের অভাবে এক দিনে ১৬টি রুটে রেল চলাচল বন্ধ থাকে- এর চেয়ে ব্যর্থতার আর কী উদাহরণ থাকতে পারে।
তেল-বিদ্যুতের মতো আরো একটি বড় সংকট হচ্ছে সার। কৃষকরা সারের জন্য দিনের পর দিন ধরনা দিচ্ছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। কিন' সার মিলছে না। অথচ শিল্পমন্ত্রী বলেন, দেশে কোনো সার সংকট নেই- এই সংকট মিডিয়ার সৃষ্টি। কৃষকরা সার না পেয়ে দল বেঁধে আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছে। তারা বলছে সার না দিলে বিষ দেন। অথচ সরকারপ্রধানকে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। আমার মনে হয় দেশের প্রকৃত অবস'া তাকে অবহিত করা হয় না। ডিজেলের অভাবে যদি আগামীকাল ট্রেন চলতে না পারে তাহলে সেটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অজানা থাকার কথা নয়। কৃষকের চাহিদা মতো সার সরবরাহ করা যাবে কিনা তাও মন্ত্রণালয়ের না জানার কথা নয়। কিন' এসব বিষয় সরকারপ্রধানকে অবহিত করা হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মন্ত্রী বলেছেন, তাদের নাকি ২ গোডাউন সার মজুদ আছে। দেশের ৮০ ভাগই যেখানে কৃষক সেখানে ২ গোডাউন সার কতটুকু চাহিদা মেটাতে পারে।
বিমান একটি দেশের গৌরবের প্রতীক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন জাতীয় পতাকাবাহী বিমান পৌঁছে, তখন সেখানে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়। অথচ সেই বিমান এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এসব সমস্যা নিয়ে দেশের সংসদ দিতে পারছে না কোনো সিদ্ধান- কিংবা কোনো সংকটের সমাধান। কীভাবে সংসদ কার্যকর হবে? যে সংসদে কথা বলতে না পারার উসিলায় একটানা সোয়া বছর প্রধান বিরোধী দল সংসদের বাইরে কাটায়, আবার সরকারি দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও যখন সংসদে প্রায় প্রতিদিন কোরাম সংকট হয়- সেই সংসদ দেশ ও জাতির সমস্যার কী সমাধান দেবে? দেশের এই দুর্দশা দেখে আমার হৃদয় ভারাক্রান- হয়ে যায়।
এবার কিছু পেছনের কথা বলি : আমার শাসনামলে বিরোধী দল আমাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনে আসার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলো। আমি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম। সাংবিধানিক পন'ায় তিন জোটের মনোনীত প্রার্থী প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে আমি উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে তার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন' তিন জোট কথা রাখেনি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন প্রতিশ্রুতি ভেঙে আমার প্রতি সবচেয়ে বড় অবিচার করেছেন। আমি বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলাম- আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো। টঙ্গী থেকে আমার প্রচার অভিযান শুরু হবে। এটাই ছিলো আমার অপরাধ। তাই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার বাতিল করা বিশেষ ক্ষমতা আইনে অবৈধভাবে আমাকে গ্রেফতার করলেন। আমার মন্ত্রীদের গ্রেফতার করা হলো- তাদের নামে হুলিয়া জারি করা হলো। সকল দল সব ধরনের নির্বাচনী সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচন করলেও বঞ্চিত হলো জাতীয় পার্টি। তারপরও আমার দল চরম প্রতিকূল অবস'ার মধ্যে নির্বাচন করে ৩৫টি আসনে জয়লাভ করলো। আমি জেলে থেকে নির্বাচন করে ৫টি আসনে জয়লাভ করলাম, একবার নয় দু’বার। আমার দলের উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল মন্ত্রী কারাগারে থেকে অথবা হুলিয়া মাথায় নিয়ে জয়লাভ করলেন। জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে আমরা স্বৈরাচারী ছিলাম না। তাহলে আমিসহ আমার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা নির্বাচনে জয়লাভ করতেন না।
তারপর আমি যাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে না পারি তার জন্য সংবিধানও পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি আমি কায়েম করিনি। এটা প্রবর্তন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এই পদ্ধতি ধারণ করেছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি পেয়েছিলাম। যারা সংসদীয় ব্যবস'া প্রবর্তন করেছেন- তারা কি এই ব্যবস'াকে কার্যকর করতে পেরেছেন? ব্যক্তিবিশেষের কারণে যারা সংবিধান কাটাছেঁড়া করেন তারা সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দাবি করতে পারেন না। এক ব্যক্তির ৬ মাসের চাকরির জন্যও সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।
আপনারা জানেন- বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সন্ত্রাসের যে বিষবৃক্ষ অঙ্কুরিত হয়েছিলো, বর্তমান সরকারের আমলে তা ডালপালা ছেড়েছে। বিগত সরকারের আমলে শুনেছি- মাটির নিচ থেকে হলেও সন্ত্রাসীদের ধরে আনা হবে। কিন' মাটির নিচে কোনো সন্ত্রাসী পাওয়া যায়নি। সন্ত্রাসীদের দেখা যেতো মন্ত্রীদের ড্রইংরুমে। বর্তমান সরকারের আমলে সেই সন্ত্রাস ভয়াবহ আকার ধারণ করলে অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনা করতে হয়। এতে সন্ত্রাস দমন হলেও এক সময় আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে সন্ত্রাস দমনে র্যাব গঠন করতে হয়। র্যাবের তৎপরতা সফল হয়েছে- এটাই বর্তমান সরকারের একটি বড় অর্জন। তাই আমি র্যাবকে ধন্যবাদ জানাই।
আবার র্যাবের তৎপরতার মধ্যেই আকস্মিকভাবে জঙ্গিদের আত্মঘাতী তৎপরতা শুরু হয়। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নাজুক অবস'ার সৃষ্টি হয়েছিলো জঙ্গি তৎপরতার কারণে। সে সময় ঢালাওভাবে দোষ দেয়া হয়েছিলো মাদ্রাসার ওপর। আমি বলেছিলাম, যেখানে হতদরিদ্র মানুষের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে- যারা দু’বেলা ঠিক মতো খেতেও পায় না, মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে যে প্রতিষ্ঠান চলে সেই মাদ্রাসাকে ঢালাওভাবে দোষ দেবেন না। আজ পর্যন- প্রমাণিত হয়নি যে, কোনো মাদ্রাসা জঙ্গি সন্ত্রাসের সাথে জড়িত।
এখন দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কিন' মানুষের আয় বাড়েনি। প্রত্যেকটি পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশের শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখো লাখো শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের ৪ কোটি যুবকের মধ্যে ৩ কোটি বেকার। তার মধ্যে ৪৫ ভাগই নিরক্ষর। প্রতি বছর ২৭ লাখ শিক্ষিত যুবক শ্রম বাজারে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকে। তাদের কর্মসংস'ানের সুযোগ সৃষ্টি হয় না। বেকারত্বের কারণে তারা হতাশায় ভুগে বিপথগামী হয়ে পড়ে।
এবার বিরোধী রাজনীতির কথা বলি : প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়েছে। তা না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা করেছে। সরকার বলে দিয়েছে- তারা ওই দাবি মানবে না। ফলে আগামী নির্বাচন নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে যতটা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে- বিরোধী দলে এসে আরো ব্যর্থ হয়েছে। তারা সরকার পতনের জন্য ট্রাম্পকার্ড দেখানোর জন্য ৩০ এপ্রিলের একটা ডেডলাইন দিয়েছিলো। দেশ ও জনগণের স্বার্থে তারা কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি। লক্ষ্য ছিলো একটাই- সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করতে হবে। তার জন্য একের পর এক ব্যর্থ আন্দোলন করেছে। জনসমর্থনহীন হরতাল ডেকেছে। মানুষের মধ্যে কোনো আবেদন তারা সৃষ্টি করতে পারেনি। নিজ দলের নেতাকর্মীদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা আওয়ামী লীগ। অথচ তারা কখনোই সংসদকে কার্যকর করতে ভূমিকা পালন করেনি। সংসদীয় সরকার ব্যবস'ার প্রথম সংসদ তারা বর্জন করেছে। তখন একদলীয়ভাবে বিএনপি সংসদ চালিয়েছে। তারপর আওয়ামী সরকারের আমলেও অধিকাংশ সময় প্রধান বিরোধী দল সংসদে থাকেনি। আওয়ামী লীগ একদলীয়ভাবে সংসদ চালিয়েছে। বর্তমান বিএনপি সরকারের আমলে প্রধান বিরোধী দলকে কথা বলতে না দেয়ার অজুহাত এনে তারা সংসদ বর্জন শুরু করে। কিন' বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, বিদেশ ভ্রমণ সবই উপভোগ করতে থাকেন। সংসদ সদস্য পদ যখন চলে যাবার উপক্রম হয়- তখন তারা আবার সংসদে প্রবেশ করেন। অর্থাৎ দেশ ও জনগণের জন্য সংসদে কথা বলা বা সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন তাদের মুখ্য বিষয় নয়। নিজেদের স্বার্থ রক্ষাই বড় কথা। গত ৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ শুধু সরকার পতনের আন্দোলনই করলো। শেষ পর্যন- তারা দুই মাসের আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলো। চূড়ান- কর্মসূচি ছিলো ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ। জাতি মনে করলো না জানি কী ঘটে বসে লংমার্চ ঢাকায় পৌঁছে গেলে। পত্র-পত্রিকায় বিশাল বিশাল শিরোনাম হয়েছে-“লংমার্চ ধেয়ে আসছে রাজধানীর দিকে।” কিন' আমরা কী দেখলাম- সেই ধেয়ে আসা লংমার্চ ঢাকায় এসে ঘোষণা করলো- “আমরা সংসদে যাবো।” লংমার্চের ফলাফল নিয়ে একজন কলামিস্ট লিখেছেন- পর্বতের মূষিক প্রসব হয়েছে। দেড় বছর পর যদি বুঝে থাকেন যে, সংসদে যেতে হবে, যাওয়া উচিত- তাহলে এতদিন সংসদে গিয়ে জনগণের জন্য কথা না বলার জন্য কি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত ছিলো না? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে কী করেছে সে কথাও এদেশের জনগণ ভুলে যায়নি। বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, ডাকাতি-ধর্ষণ, লুটপাট, দলীয়করণ, দুর্নীতি তখনও সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছিলো। পুলিশের প্রধান কাজ ছিলো বিরোধী দল দমন।
মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। তারা স্মরণ করে জাতীয় পার্টির শাসনামলের কথা। আমার তো রাজনীতিতে আসার কথা ছিল না- ইচ্ছাও ছিলো না। ক্ষমতা গ্রহণের ২ বছরে দেশে সুশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে আমি ১৯৮৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলাম। তখন আমার কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। সেই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করলে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আমি আবার ব্যারাকে ফিরে যেতাম। কিন' সেদিন রাজনৈতিক দলগুলোর অদূরদর্শিতার কারণে আমাকে রাজনৈতিক দল গঠন করতে হয়। সেই পার্টি অনেক ঘাত-প্রতিঘাত-সুখ-দুঃখের পথ পাড়ি দিয়ে আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। জাতীয় পার্টির শাসনামলের ইতিহাস উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও সু-সংস্কারের স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় নিয়ে রচিত। ১৫ বছর পরও আমরা দেখাতে পারি আমাদের উন্নয়নের দৃশ্য। প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে নতুন জেলা উপজেলা প্রবর্তনের ফলে এদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মানুষ প্রথমবারের মতো উন্নয়ন-সমৃদ্ধি উপলব্ধি করতে শুরু করে। ভূমি সংস্কার, খাস জমি বিতরণ, গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠা, যুগান-কারী ওষুধনীতি, কৃষি ব্যবস'ার সংস্কারের কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। আমার ৯ বছরের শাসনামলে সারাদেশে ১০ হাজার কিলোমিটার রাস-া পাকা হয়েছে। ১৫ হাজার ছোট বড় সেতু-কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। কৃষি-শিক্ষা-ধর্ম-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস-বায়ন, কূটনীতিসহ এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে আমার উন্নয়ন-সমৃদ্ধির ছোঁয়া লাগেনি। আমি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছি, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেছি, রেডিও-টিভিতে আজান প্রচারের ব্যবস'া করেছি। অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কার করেছি, মসজিদ-মন্দিরসহ সকল উপাসনালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফ করেছি। আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয় করে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন করেছি, সারা দেশে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস'া করেছি। ইসলামের সেবায় এত কিছু কাজ করলেও আমার সময়ে দেশকে কেউ মৌলবাদী দেশ বলতে পারেনি। আমার সময়ে দেশে সন্ত্রাস-জঙ্গি তৎপরতা ছিলো না। র্যাব-চিতা-কোবরা গঠন করতে হয়নি। অপারেশন ক্লিন হার্টের প্রয়োজন হয়নি। আমার সময় দেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়নি। আমার সময়ে বাংলাদেশ কালো তালিকায় ওঠেনি। আমার সময়ে দেশ ব্যর্থ-অকার্যকর রাষ্ট্রের প্রক্রিয়ায় যায়নি। আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছি ১৫ বছর আগে। মাত্র এই সময়ের মধ্যে জাতির ললাটে এতগুলো কলঙ্কের তিলক অঙ্কিত হয়েছে। আমরা ৯ বছরে দেশের যত উন্নয়ন করেছি- স্বাধীনতার বাকি সময়ে সব সরকার মিলে তা করতে পারেনি। তারপরও আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। আমার শাসনামলের পুরো একটি বছরের সময় বিরোধী দল হরতাল করেছে। তারপরও জাতীয় পার্টির উন্নয়নের গতি স-ব্ধ করতে পারেনি। রাজনীতির জন্য আমাকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে- যে নির্যাতন, অবিচার সহ্য করতে হয়েছে- এদেশের আর কোনো রাজনীতিকের জীবনে তা আসেনি। একনাগাড়ে ৬টা বছর কারাগারে দুঃসহ জীবনযাপন করতে হয়েছে। সাড়ে তিন বছর আমাকে কারো সাথে কথা বলতে দেয়া হয়নি। ১২টা ঈদ চলে গেছে জামাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারিনি। ৬টা রমজানে সেহেরী খেয়ে রোজা রাখতে পারিনি। আমার তো বাঁচার কথা ছিল না। আমি জন্ডিসে আক্রান- হয়েছিলাম। বিলোরুবিন ২৯ পর্যন- উঠেছিলো। অথচ কোনো রোগীর বিলোরুবিন ১৮ হলেই তার বাঁচার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। আমি বেঁচে রয়েছি অলৌকিকভাবে। আপনাদের দোয়ায় আমি নতুন জীবন লাভ করেছি।
আমি কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। তবে দেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে যে- বিগত ১৫ বছর যে দু’টি দল রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে তারা দেশের উন্নয়ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস-বায়নে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের পক্ষে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং সমাজের সর্বস-রে শানি--শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করা আদৌ সম্ভব নয়। গত তিন মাসে আমি দেশের যেখানেই গেছি- সেখানেই রব উঠেছে, দুই দলকে আর চাই না। তারা পরিবর্তন চায়। বিকল্প শক্তির উত্থান দেখতে চায়। একমাত্র জাতীয় পার্টিই হতে পারে সেই বিকল্প শক্তি। দেশবাসী তিনটি দলের রাষ্ট্র পরিচালনা বিচার-বিশ্লেষণ করেছে। এবার জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে তারা বিকল্প শক্তির উত্থান ঘটাতে চায়। আমরা কোনো পক্ষের ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারি না। আমাদের সামনে নতুন দিগন- উন্মোচিত হয়েছে। তাই আমরা কোনো জোটে যাবার কথা ভাবছি না। এককভাবেই ৩০০ আসনেই নির্বাচনের জন্য প্রস'তি গ্রহণ করবো। তবে সময়ের দাবিতে ন্যূনতম কর্মসূচিতে ক্ষমতার অংশীদারিত্বের সমঝোতায় জোট গঠন করতে পারি। সারা বিশ্বের প্রতিপালক যে মহান আল্লাহ পাক, মুসলিম-অমুসলিম সকল মানুষের স্রষ্টা- সেই মহান স্রষ্টার উপর ভরসা করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের আপামর জনগণকে সাথে নিয়ে আমি এগিয়ে যাবো। জনগণের সাথেই হবে আমার মহাজোট। আমি জনগণের উদ্দেশে বলেছি, আপনারা যার যার এলাকায় ফিরে যাবেন। গড়ে তুলুন দেশজুড়ে জাতীয় পার্টির দুর্ভেদ্য দুর্গ। মনে রাখবেন- পার্টির অসি-ত্ব রক্ষায় এটাই হবে শেষ সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদের জিততেই হবে। আমরা যদি আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রতীক লাঙ্গলের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি করে ক্ষমতায় যেতে পারি তাহলে এদেশের মানুষের মুখে আবার হাসি ফোটাতে পারবো ইনশাল্লাহ। আমরা যদি ক্ষমতায় যেতে পারি তাহলে দেশ ও জাতির স্বার্থে যে সব কর্মসূচি বাস-বায়ন করবো- এখন তা আপনাদের সামনে উপস'াপন করতে চাই। মহাসমাবেশে আমি যে সব কর্মসূচি ঘোষণা করেছি, সেগুলো হলো : এক. উপজেলা আদালত ও পারিবারিক আদালতসহ পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস'া চালু করা হবে। স'ানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করা হবে এবং নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে উপজেলার ক্ষমতা হস-ান-র করা হবে। দুই. প্রাদেশিক ব্যবস'া প্রবর্তন করা হবে। তিন. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেয়া হবে। চার. নির্বাচন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেয়া হবে এবং সন্ত্রাস, অস্ত্র ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। পাঁচ. ধর্মীয় মূল্যবোধ সবার ঊর্ধ্বে স'ান পাবে। মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফ করা হবে। ছয়. কৃষকদের ভর্তুকি মূল্যে সার, ডিজেল, কীটনাশক সরবরাহ করা হবে এবং কৃষি উপকরণের কর শুল্ক মওকুফ করা হবে। কৃষকদের বিরুদ্ধে কোনো সার্টিফিকেট মামলা থাকবে না। সহজ শর্তে কৃষি ঋণ সরবরাহ করা হবে। সাত. দেশের পাট শিল্পের গৌরব ফিরিয়ে আনতে আধুনিকভাবে আদমজীর মতো জুট মিল প্রতিষ্ঠাসহ বন্ধ শিল্প কারখানা চালু করা হবে। প্রত্যেক উপজেলায় বিসিক শিল্প নগরী গড়ে তোলাসহ কৃষিভিত্তিক শিল্প স'াপন করা হবে। আট. সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি দমনে আরো কঠোর আইন প্রণয়ন করা হবে। নয়. উত্তরবঙ্গসহ দেশের সর্বত্র পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস'া গ্রহণ করা হবে। সারা দেশে সুসম উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। দশ. গুচ্ছগ্রাম, পথকলি ট্রাস্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। এগার. পল্লী রেশনিং চালু করা হবে। বার. উত্তরবঙ্গে শিল্পায়নের ব্যবস'াসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মঙ্গা প্রতিরোধের উদ্যোগ নেয়া হবে। তের. বাজার দরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি বেতন ভাতা বৃদ্ধি করা হবে। সর্বশেষ মূল বেতনের সমান পেনশন দেয়া হবে। চৌদ্দ. বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ৯০ ভাগ থেকে ১০০ ভাগে উন্নীত করা হবে। পনের. সুলভ মূল্যে শিক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করা হবে। নিবন্ধনকৃত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন সরকারি শিক্ষকদের সমতুল্য করা হবে। ষোল. স্নাতক শ্রেণী পর্যন- নারী শিক্ষা অবৈতনিক করা হবে।
এই ষোল দফা কর্মসূচির প্রতি যদি আপনাদের সম্মতি থাকে তাহলে আমাকে সমর্থন জানাবেন। আমি কল্পনাবিলাসী রাজনীতিবিদ নই। দেশ পরিচালনায় আমার অভিজ্ঞতা আছে। দেশ ও জাতির জন্য যা করতে পারবো, বাস-বতার ভিত্তিতে আমি ন্যূনতম সেই কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি। দেশের নারী সমাজের কল্যাণে এবং তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে আমি সুচিনি-ত কর্মসূচি গ্রহণসহ আরো জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপের কথা আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে পেশ করবো। আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। আপনারা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা জনগণের দ্বারে দ্বারে যাবেন। তাদের কাছে ভোট প্রার্থনা করবেন। জাতীয় পার্টির হতাশার দিন কেটে গেছে। আগামী নির্বাচনে আমরা অবশ্যই ইতিহাস গড়তে পারবো।
এদেশের নির্বাচনের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের কাছে শেরেবাংলার মতো নেতার দলের ভরাডুবি হয়েছে। আবার ১৯৫৪ সালে ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছে। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার কাছে সব দল ম্লান হয়ে গেছে। আবার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর ১৯৭৯-এর নির্বাচনে সেই আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৩৯ আসন লাভ করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির কোনো সাংগঠনিক ভিত ছিলো না। তখন বিএনপির দলীয় অবস'া এখনকার জাতীয় পার্টির চেয়েও খারাপ ছিলো। তাই আওয়ামী লীগের নেত্রী বলেছিলেন, নির্বাচনে বিএনপি ১০টি আসনও পাবে না। কিন' ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সেই বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে যে আওয়ামী লীগ আন্দোলনের সাফল্যের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো- ২০০১ সালে তাদেরই পতন হয়েছে। এই সব ইতিহাসের স্রষ্টা এদেশেরই জনগণ। তাই আগামী ২০০৭ সালের নির্বাচনে আর একটি বিরল ইতিহাস গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আপনারা যে যার অবস'ানে থেকে জাতীয় পার্টির জন্য কাজ করে যাবেন।
প্রিয় দেশবাসী, কাজ করতে গেলে মানুষ মাত্রেই ভুল-ত্রুটি হতে পারে। আমিও তার ঊর্ধ্বে নই। ভুল-ত্রুটি আমারও হয়তো হয়েছে। যদি ইচ্ছার অজ্ঞাতে কোনো ভুল করে থাকি তার জন্য আমি এই মহাসমাবেশে দাঁড়িয়ে আপনাদের কাছে- দেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আপনাদের প্রতি আমার আকুল আবেদন, আসুন দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি। যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে তাকে কাজে লাগাতে আসুন আমরা জীবনের বাজি ধরি- ‘হয় করবো- নয়তো মরবো’। আপনারা আমাকে আর একটিবার সুযোগ দিন। আমি জীবনের শেষ প্রানে- এসে পৌঁছেছি। আমার আর চাওয়া পাওয়ার কিছু বাকি নেই। যত দিন বাকি তত দিন দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশ ও জাতির সেবা করে যেতে চাই। আর একবার চেষ্টা করে দেখি এই বিপর্যস- দেশকে রক্ষা করে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি কিনা- সেই সুযোগ প্রার্থনা করে মহাসমাবেশ সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আমার বিরোধী রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে সফল ও সুশৃংখল এই কর্মসূচি আমাকে শুধু উৎসাহই জোগায়নি- আমি পেয়েছি নতুন দিক-নির্দেশনা। আমি যেনো জনতার কাতারে এক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সেই বক্তব্য যারা শুনতে পাননি অথবা শোনার সুযোগ ছিলো না- আশা করি এই লেখাটি তাদের জন্য সহায়ক হবে।