
কবিতায় আমার স্মৃতিময় ঈদ
“রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...” কাজী নজরুলের এই অমর সঙ্গীতটির সুরে সুরে মনের মাঝে মহাপবিত্র আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত হয়। সে অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। কবি গোলাম মোস-ফা কবিতার ভাষায় বলেছেন,
“সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মুরতি লভিয়াছে হর্ষে,
আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভার জাগিয়াছে, রাখিতে হবে সারা বর্ষে
এ ঈদ হোক আজ সফল ধন্য, নিখিল মানবের মিলনের জন্য;
শুভ যা জেগে থাক, অশুভ ঘুরে যাক, খোদার শুভাশীষ পর্শে”
ঈদ নিয়ে প্রায় সব মুসলিম কবিই কিছু না কিছু লিখেছেন। বর্তমানে কবিতার ছন্দে আধুনিকতা এসেছে। আধুনিক কবিরাও ঈদ নিয়ে কবিতা লিখছেন। তবে আগের ছন্দে নয়। লিখছেন গদ্যের ছন্দে। অনেকেই বলেন- আধুনিক কবিতা বুঝতে কষ্ট হয়। কবিতার পাঠকও অপেক্ষাকৃত কম। তবে কবিতা যারা পড়েন তারা কিন' কোনো কবির কবিতাই বাদ দেন না। বর্তমানে কবির সংখ্যাও কম নয়। বলা যায়- পয়ার যুগের চেয়ে অনেক বেশি। আমিও কবিতা লিখি। তবে নিজেকে একজন সফল কবি ভাবি না। কবিতার প্রতি রয়েছে আমার গভীর ভালোবাসা। তাই কবিতা নিয়ে সাধনা করি। সে সাধনার ফল হিসেবে নিজের মনের কিছু অভিব্যক্তি বেরিয়ে আসে। তা কবিতা হয় কিনা জানি না। তবে সেখানে থাকে আমার কাব্যের প্রতি গভীর মমত্ববোধ।
১৯৯৭ সালে জেল থেকে মুক্ত হবার পর আমার লেখা সবগুলো কবিতা সংকলিত করে ‘কবিতা সমগ্র’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছি । সে বই-এর ভূমিকায় বলেছিলাম- কবিরা কখনো পরাজিত হয় না। কবির সত্য কণ্ঠ কখনো স-ব্ধ হবে না। সত্যিই- যতো বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হই না কেনো, আমি কিন' পরাজিত হইনি। আমার কণ্ঠ স-ব্ধ হয়নি। আমার কবিতার কলম থেমে থাকেনি।
একজন কবি সাধারণত যে ধরনের সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারেন, আমি কিন' তা কখনো হইনি। আমার কবিতা ‘বাজে বা কোনো কবিতাই হয়নি’- এ ধরনের কথা আমি শুনিনি। বলা হয়েছে- যখন আমি ক্ষমতায় ছিলাম তখন নাকি আমার “তোষামুদে” কিছু কবি আমার নামে কবিতা লিখে দিতেন। যাহোক আজ আমি ক্ষমতায় নেই। এখন আমার চারপাশে কোনো খয়েরখাঁও নেই। আমি কিন' কবিতা লিখে যাচ্ছি। তবে তা সংখ্যায় বেশি নয়। রাজনীতির ব্যস-তার কারণে লেখা খুব বেশি হয়ও না। এর মাঝে কয়েকজন সম্পাদক ও সাংবাদিকের অনুরোধে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ লিখেছি। আবার কয়েকজন কলামিস্টের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়েও কিছু কথা লেখা হয়ে গেছে। হাতে সময় না থাকলেও লেখার জন্য সময় বের করে নিতে হয়েছে। যাহোক যে বিষয় নিয়ে এই নিবন্ধে আলোচনার অবতারণা করতে চেয়েছি তা কিন' এসব প্রসঙ্গে নয়। শুরুটাই করেছি পবিত্র ঈদ নিয়ে এবং ঈদ প্রসঙ্গেই কিছু কথা বলতে চাই। এখানে আমার প্রসঙ্গ হলো ঈদের কবিতা।
ইতিপূর্বে ঈদ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় কোনো নিবন্ধ আমার লেখা হয়নি। ঈদ উপলক্ষ করে কিছু কবিতা লিখেছি। তবে তা ঈদের মাহাত্ম্য বর্ণনামূলক নয়। সেখানে শুধু ঈদের প্রসঙ্গ এসেছে। এবার ঈদকে সামনে রেখে ঈদ উপলক্ষে কোনো কবিতার কথা চিন-া না করে ঈদের কবিতা নিয়ে আমার কিছু স্মৃতিকথা আলোচনা করতে চাই। এই আলোচনায় কবিরা তাদের কবিতায় ঈদকে কীভাবে উপজীব্য করেছেন তার বিশদ বর্ণনা দিতে পারলে নিবন্ধটি হয়তো সমৃদ্ধ হতো। তবে আমি সেদিকে যাবো না এবং এ বিষয়ে বিস-ারিত তথ্যও আমার সংগ্রহে নেই। আমি নিজে কবিতায় ঈদকে কীভাবে উপস'াপন করেছি, তার দু’চারটি কথা এবং প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে পারবো হয়তো। আমি কবিতায় কোনো জটিল ভাষা প্রয়োগ করতে পারি না। নিজে সোজাভাবে যা উপলব্ধি করি, সেটাই সরলভাবে বর্ণনা করি। একবার ঈদকে সামনে রেখে যখন কবিতার কথা ভাবছিলাম তখন মনের আকাশে উজ্জ্বল তারার মতো জ্বলে উঠেছিলো একটি মানুষ- যার নাম কমরুদ্দি। সেই লোকটিই হয়ে গেলো আমার কবিতার উপাদান। তাকে নিয়ে লিখলাম- “একটি ঈদ, নতুন বাংলার কমরুদ্দি”,
তাকে দেখেছি কতোবার
আপন পরিক্রমায় একান- আপন মনে
ডাক দিয়ে গেছে মরমিয়া গানে
মানুষের প্রাণে
রাত্রির নিয়মে
আমি প্রত্যক্ষ করেছি তাকে
সেই কবে আমার পিতার সময় থেকে
কী এক আশ্চর্য একাগ্রতায়
সে বলে গেছে
তোমরা ওঠো সেহরির সময় হয়েছে এখন
আজান পড়েছে তারপর তিস-ার নির্জন চরে
বিস-ীর্ণ বাতাসে।
তার কণ্ঠের পরিচিতি হাঁক এখনো কানের কাছে
ক্রমাগত কথা বলে
তিরিশটি দিন সে জেগে থাকে
যেন এক দৃঢ়তার অবিচ্ছিন্ন ছায়া
তীক্ষ্ণ এক ছবির শরীর
আমার পিতার সময় ছিলো সেই বলিষ্ঠ কৃষক
কমরুদ্দি নাম যার
কোনোদিন বলেনি যে, তারো আছে
অনেক খাবার লোক
তারো চাই অনেক পরার কাপড়
অভাবের পুরনো দেয়াল এক
অবরুদ্ধ করেছে জীবন
সেও বসে থাকে অপেক্ষার দীর্ঘ পথে
কবে পাবে ফসলের দাম
একখণ্ড ভূমি তার নিজের সন-ানের মতো।
পরনে একদা দেখেছি তার খোপকাটা
লুঙ্গির কাপড়
রঙিন ফতুয়া গায়ে আর কাঁধে লাল রঙ
গামছার সনাতন শরীর
কবেকার রৌদ্রস্নাত, ক্রমাগত পুড়ে পুড়ে
হয়েছে ধূসর
এবং বসে আছে অপেক্ষার দীর্ঘ পথে
কবে পাবে ফসলের দাম।
কখনো পাতেনি হাত কারো কাছে
নেয়নি দয়ার দাম কোনোদিন
কখনো বলেনি কারো কাছে নিজের সেহরি তার
জোগাড় করেছে কীভাবে।
এতোদিন পরে রোজার মাসের শেষে
তার মুখ শুধু ভাসে
আমার ঋণের ফিকে রঙ পটভূমি জুড়ে
একান- স্বচ্ছ এক ছবির মতোন
তাকে যদি এখন পেতাম আমি কাছে
ঈদের দিনের এই একান- মুহূর্তে
বিনীত শ্রদ্ধায় তাকে জানাতাম
বলতাম প্রকাশ্য উচ্চারণে
হে বন্ধু হে চিরায়ত বাংলার কমরুদ্দি
এ ঈদ তোমার
তোমার বিশ্বাসের সেতু বেয়ে
আমরা করেছি অতিক্রম সিয়ামের মাস
আমার চিরদিনের বাংলার কমরুদ্দি
আমার নতুন বাংলার
তোমার মধ্যেই আমি কেবলি দেখেছি সেই
রোজাদার সাহসী সংযমী মানুষ
সকল ঈদের কবিতা তাই মিশে আছে
তোমার একান- সেই কণ্ঠ জুড়ে
সেহরির সময় হয়েছে এখন তোমরা ওঠো
আজান পড়েছে তারপর তিস-ার নির্জন চরে
বিস-ীর্ণ বাতাসে।
আমার বর্ণনার কমরুদ্দি শুধু একজন ব্যক্তি নয়। সে সারাদেশের কমরুদ্দিদের প্রতীক। আগেই বলেছি ঈদের মর্মবাণী নিয়ে আমার কবিতা লেখা হয়নি। তবে ঈদের আনন্দধারায় অবগাহন করার সুখ অনুভবের আগে কমরুদ্দিদের ছবিগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাই ঈদের কবিতায় ওদের মুখগুলো রচনা করেছি হৃদয়ের গভীর আকুতি দিয়ে। এবার ঈদকে সামনে নিয়ে এখনো নতুন কোনো কবিতার কথা ভাবিনি। মনে হয়েছে পৃথিবীটা গদ্যময় হয়ে গেছে। গোটা মুসলিম জাহানে ছন্দপতন ঘটেছে। ঈদের মাহাত্ম্য যেনো ভুলতে বসেছি। কাকে ঈদ মোবারক জানাবো- কাকে আলিঙ্গন করতে পারবো- কিছুই যেনো ঠিক করতে পারি না। আজ আমরা একটি স্বাধীন দেশের বাসিন্দা। এক জাতি ও এক ভাষার মানুষের বাস এখানে। ধর্মীয়ভাবে ৯০ ভাগই মুসলমান। অন্যান্য ধর্মের যে জনগোষ্ঠী আছে তাদের নিয়ে অপূর্ব সমপ্রীতির মধ্যে বাস করে আসছি আমরা। অথচ নিজেদের মধ্যে কতো বিভেদ- বিসম্বাদ, কতো হানাহানি, হিংসা বিদ্বেষ। রাজনৈতিক বিভেদ, নীতি আদর্শের বিভেদ, মত ও পথের বিভেদ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের কিংবা কুক্ষিগত করার জন্য সংঘাত ও নৃশংসতা- অরাজকতা। সকল ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবণতা। দেশজুড়ে বোমা হামলা হয়। এক সময় মিছিলের স্লোগানে শুনতাম- ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। এখন বাস-বে দেখছি ঘরে ঘরে অস্ত্রাগার গড়ে উঠছে। কারা এই অস্ত্রগোলাবারুদ নিয়ে ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছে? কি তাদের উদ্দেশ্য? কি চায় তারা? এই অস্ত্র দিয়ে কাদের বুক ঝাঁঝরা করতে চায়- কাদের শরীর ছিন্নভিন্ন করতে চায়? এসব চিন-া মাথায় এলে মনের মধ্যে ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে আসে। কমরুদ্দিদের মুখগুলো পর্যন- চোখের সামনে ঝাপসা মনে হয়। কবিতায় ছন্দ হারিয়ে ফেলি। অথচ কবিতা আমার জীবনের একমাত্র খোলা জানালা। এই জানালা দিয়ে তাকিয়ে আমি ঈদকে দেখেছি কতোবার। ঈদের আনন্দ ও খুশির অনুভূতি ব্যক্ত করেছি কবিতায়।
আমার কবিতা আর আমার মা উভয়ে আমার হৃদয়ের গহিন কুঠরির সহাবস'ানের বাসিন্দা। এদের একজন পরম শ্রদ্ধা আর অন-হীন ভালোবাসা, অপর বাসিন্দা আমার গভীর প্রেম। ঈদ মুসলমানের জীবনে মহাআনন্দের প্রতীক। তাই ঈদের দিনে অনুভব করি মায়ের পবিত্র স্পর্শ। আর হৃদয়ের প্রেমে উপলব্ধি করি কবিতার প্রতি ভালোবাসা। উভয়ের মিলনে আমার ঈদ হয়ে ওঠে পবিত্র আনন্দময়। একবার ঈদে মায়ের কাছে যাবার সুযোগ ছিলো না। তাই অপেক্ষায় ছিলাম মায়ের চিঠির। ঈদকে উপলক্ষ করে লিখেছিলাম একটি কবিতা। শিরোনাম ছিলো “আমার মায়ের চিঠি”। সেই ঈদের কবিতা :
সজনে গাছের ডালে দুপুরের কাক
ঠোঁট মুছে নিলো কয়েকবার
ভাঙা ভাঙা হাতের লেখায়
নিশ্চয়ই এখন আসবে সেই চিঠি
নিঃসঙ্গ মফস্বল শহর থেকে
আমার মায়ের সেই পত্র
রাত জেগে জেগে লেখা
স্নেহের অজস্র শিখায় আন্দোলিত।
অতি পরিচিত স্মারকলিপি যেনো
সেই চিঠিতে থাকবে
মানুষের কথা
আমাদের চিরচেনা
মানুষেরা সব
গরিবদের জন্য চাই ঈদের কাপড়চোপড়।
আমি জানি আসবে আমার মায়ের চিঠি
এই দুপুরের ক্লানি-র ভেতর।
কতোবার তোমাকে বলেছি মা
তুমি ভেবো না কখনো
আমি জানি তুমি কী চাও
কী করতে হবে আমার।
তবু মা আমার কখনো মানতে চায় না
আমার মায়ের মন পড়ে থাকে
গ্রামবাংলার মাঠে বিপন্ন মানুষের কাছে।
সজনে গাছের ডালে দুপুরের কাক
ঠোঁট মুছে নিলো কয়েকবার
এখন আসবে চিঠি আমার মায়ের।
ঠিকই মায়ের চিঠি যথাসময়ে আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। যেমনটি প্রত্যাশা ছিলো- ঠিক তেমনই। ঈদের আনন্দের মতো সেই চিঠি পাওয়ার আনন্দ। একে অপরের পরিপূরক। দু’য়ে মিলে আমার ঈদ হয়েছে ছন্দময়। এবার ঈদকে সামনে নিয়ে ঈদের কবিতার স্মৃতিমন'ন করতে বসেছি। নতুন কবিতার অবগুণ্ঠন এখনো কেনো খুলতে পারছি না- সে হিসাবটাও মিলিয়ে দেখতে পারিনি। কবিতা আমার জীবনের খোলা জানালার মতো হলেও নিজের চারদিকে আছে অনেক দৃশ্যমান বা অদৃশ্য দেয়াল। নানাবিধ সমস্যার জাল অক্টোপাসের মতো বেঁধে রাখে। রাজনৈতিক, সাংসারিক, সামাজিক এবং দেশের চিন-াতো আছেই। আরো আছে সময়ের সীমাবদ্ধতা। তাছাড়া প্রত্যেক মানুষের সামনে যে দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে, সেই তুলনায় জীবনের পরিধি অনেক ছোট। আমরা সেই ছোট্ট জীবনকেই নিয়ে যেতে চাই সীমাহীন মুক্তির আলোকে। মুক্তির এই আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে মানুষের পবিত্র এবং সর্বোত্তম প্রত্যাশা। মানুষের আত্মার ওপর যে জানালা দিয়ে এক টুকরো আলো এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জীবনকে ঝলমলে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে, তারই নাম কবিতা। আমার উপলব্ধি তাই। এই উপলব্ধিটাকে যে কাজে লাগাতে পারে, সে-ই কবিতাকে আলোতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। একটি কবিতাকে মুক্তি দিতে পারে। কবিতাকে মুক্তি দেয়ার স্বাদ যে কতো মধুর তাও ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। তবে আমার কবিতাকে মুক্তি দেয়ার চেতনাও দীর্ঘ সময়ের জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিলো। আমি একদা একটি উৎসবে যাবার প্রত্যাশায় মনের মাঝে ছন্দের ছবি এঁকেছিলাম। কবিতার ভাষায় সেখানে বলেছি :
উৎসব আক্রান- নয় আজো। যদিও
কতিপয় লোক উৎসবের বিপক্ষে- ঐতিহ্য
বিকৃতির কাজে নিয়োজিত। এদেশের মাটিতে
একদা আজানের ধ্বনি, ফসলের গান আর
শুভেচ্ছা বিনিময়ে পরিচয় পূর্ণ হতো। অন-র
থাকেনি শূন্য। কোথাও কারো না কারো
জন্ম হতো প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার নিয়মে।
ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। প্রানবন- প্রিয়ার
মনে ঝড়ে না মধু। আন-রিক কোনো মুখ
ওঠেনা ভেসে সাহসীর যোদ্ধার চোখে
যুদ্ধে যাবার আগে। অন-রে হাহাকার!
বিপন্ন সম্পর্ক খুলে দেয় অশানি-র দ্বার-
নীরব সাক্ষীরা সব ইতস-তঃ ছড়ানো
কখনো সচল কখনো অচল অবস'ার
শিকার তারা। ভীত অবনত সময়ের কাছেও
পরাজিত তারা। বিবেক থেকেও মৃত।
আকাশের নীলের সাথে দেখা হয় যখন
থাকে না পাখিদের গান আঙ্গিনায়-
থাকে শুধু ক্রন্দন, দরিদ্রের নীচে যাদের
কৌতুক নাচে। আনন্দ করার কথা যার
সে বালক বিব্রত। সাহসী হবার কথা যার
সে নাবিক আজ দিশেহারা প্রাণ।
তবুও পাখিরা ফেরে ঘরে দিনশেষে
গান থাকে, রৌদ্র-মেঘ-ঝড়-বৃষ্টি
সব থাকে- থাকবে চিরদিন। নিমেশে
কেউ হয়তো চলে যায় এ জগত ছেড়ে
জগত থেমে থাকে না তারপরও। মানুষ
প্রার্থনায় দাঁড়াবে প্রতিদিন কথা ছিলো;
ক্ষমা চাওয়ার অধিকার সংরক্ষিত থাকবে
সে কথাও ছিলো একদা। কি যে হলো অঙ্গনে
বদলে গেলো দৃশ্যপট চোখের পলকে।
হারায় ইতিহাস দ্রুত পুরুষ ও নারী। জীবনের গতি
থেমে থাকে শহরের পতাকার নীচে।
রচিত হয় না উপন্যাস-কবিতা-গল্প সেভাবে;
পুরুষ এবং নারী চাহিদা অতিরঞ্জিত করে
ভুলে যায় দাঁড়াতে প্রার্থনায়। কেনো এ ভুল
এর উত্তর তাদের জানা নেই। অপ্রতুল আলো
এবং আরো কতোদূর যেতে হতে তাদের অজানা।
তবুও উৎসবে যাবার সুযোগ অতি সহজে
গলিয়ে যায় মন থেকে হৃদয়ে,
থেকে যায় কবিতায় এবং জীবনে-
হেঁটে যায় কাল থেকে মহাকালে।
কবে কখন আমার মনে কবিতার চেতনা জাগ্রত হয়েছিলো তার দিনক্ষণ কিছুই মনে নেই। এটুকু শুধু মনে পড়ে, আত্মপ্রকাশের একটা প্রবল আবেগ প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম কবিতার দু’টি চরণ যখন ইচ্ছার অজানে-ই অগোছালোভাবে কাগজের বুকে লিপিবদ্ধ করেছি। সময়টা ঠিক মনে নেই। সেটা হয়তো কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণ হবে। ফুল ও ফসলের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা নানা বর্ণে নানা রূপে জীবনের ঋতু পরিবর্তনের এক অপূর্ব মুহূর্তে যখন প্রবেশ করেছে- ঠিক তখন এক মোহনীয় আলোকবর্তিকা শানি-মন্ত্রধ্বনি হয়ে আমার হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলো। সে ছিলো আমার কবিতা- আমার হৃদয়ের রানী, আমার সাধনার আরাধ্য প্রেমিকা। আজ জীবনের সামনে যখন সায়াহ্নছায়া অপেক্ষা করছে তখন মনে হয় যাকে আমি ইচ্ছার অজানে-ই অবলীলায় পেয়েছিলাম তাকে যেনো লালন করেছি অবহেলায়। আজ মনে হয় জীবিকার জন্য যদি সৈনিক জীবন বেছে না নিতাম- ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা যতোই দেখা দিক না কেনো, যদি রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ না করতাম অথবা অনিবার্য কারণে রাজনীতির জটাজালে পা দু’টোকে জড়িয়ে না ফেলতাম, তাহলে হয়তো অলৌকিকভাবে যে আনন্দের ভার আমার ওপর অর্পিত হয়েছিলো তাকে আঁকড়ে ধরেই আত্মপ্রকাশের প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে সফল করতে পারতাম।
মানুষ অনায়াসে যা পায় তার অধিকাংশই অবহেলায় হারিয়ে ফেলে। আমার জীবনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কাব্যকে আমি যথাযথ আদরে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। তারপর আবার সে কবিতা যখন তন্দ্রাতুর চোখে স্বপ্নের রানী হয়ে বিচরণ করতে চেয়েছে তখন কোনো এক কালো ব্যাধের শরাঘাতে সে আহত হয়েছে। আমি তাকে উদ্ধার করতে পারিনি, কারণ তখন আমি বন্দি। আমার চারদিকে উচ্চ প্রাচীর- লোহার গরাদ। একটুকরো কাগজ আর একটা কলমের জন্য আমার কবিতা শরবিদ্ধ কপোতের মতো আর্তনাদ করতো। আমি অসহায়ভাবে তখন জীবনমন'ন বিষ আকণ্ঠ পান করে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আর কবিতাকে শুধু সান-্বনাসুধায় সিক্ত করে মনের মাঝে লুকিয়ে রেখেছি। তাকে বাইরের জগতে আনতে পারিনি। সেই নির্জনের ব্যথাগুলো নতুন ছন্দে সাজানোর চেষ্টা করেছি। নতুনত্বের মধ্যে অসীমত্ব আছে। আমার জীবনের সে দুঃসহ দীর্ঘ সময়ের নির্জন-স্বজনের নিত্য সঙ্গমের মধ্যে শুধু কবিতার কথাই ভাবতাম। এই কবিতা আমার হৃদয়ের অরণ্যে তীরবিদ্ধ হরিণের মতো যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ছটফট করেছে। আমার হাত ছিলো অদৃশ্য শেকলে বাঁধা। আমি কবিতাকে সাজাতে পারিনি কলমের তুলি দিয়ে। অথচ কতো কবিতা তখন মুক্তির জন্য আর্তচিৎকার করেছে। আমি সে কবিতাগুলোকে মুক্ত করতে পারিনি। আমার হাতে কলম ছিলো না, কাগজ ছিলো না। এমনভাবে কেটে গেছে ছ’ছটা বছর। ছ’টা বসন-, ছ’টা হেমন- শরৎ শীত বর্ষা গ্রীষ্ম কখন কীভাবে কেটেছে অনুভবের সুযোগও আসেনি। বারোটা ঈদের আনন্দ কেমন ছিলো জানিনি- বুঝিনি। ঈদকে উপলক্ষ করে অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও ঈদের মর্মবাণীকে উপজীব্য করে কবিতা লেখার সাধ জেগেছিলো। কিন' সাধ্য আমার ছিলো না। তারপর ফিরে এলো মুক্তির এক মাহেন্দ্রক্ষণ। কারাপ্রাচীর থেকে বেরিয়ে এলাম মুক্ত বাতাসে। আহত কবিতাগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। কিছু পেলাম- কিছু পাইনি। কিন' হারানো ঈদ আর ফিরে এলো না।
কাব্যের জগতে আমি শুধুই একজন কবিতা-প্রেমিক। এখানে আর কোনো সত্তার ঠাঁই নেই। আমার একটি রাজনৈতিক সত্তা রয়েছে। কিন' কাব্যের মাঝে আমি রাজনৈতিক সত্তাকে বিন্দুমাত্র ঠাঁই দেই না। কবিতা কখনো দেশ-কাল-পাত্র-মত-আদর্শের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। কবিতা সার্বজনীন- কবিতার ব্যাপ্তি বিশ্বময়। আমার অন-রের একান- সাধনার সম্পদের ওপর আমি রাজনীতির পরশ লাগাতে চাই না। রাজনৈতিক কারণে আমি কারারুদ্ধ হলেও আমার সব কবিতাকে সাজাতে চাই কাব্যের মহিমায়। কারা জীবনে ঈদ আমার কেমন কেটেছে সে প্রসঙ্গে এবারই অন্য একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছি। এখানে শুধু আমার ঈদের কবিতার কথাই বলছি। আমার জীবনে দ্বিতীয়বারের মতোও কারা নির্যাতনের দুর্যোগ এসেছে। সেবার জেলে কাটাতে হয়েছে ছয় মাস। সেই সময়টা ছয় বছরের চেয়েও দুর্বিষহ লেগেছে। দুঃখবোধও ছিলো তখন প্রচুর। একটি কবিতায় সে দুঃখবোধ ব্যক্ত করেছি। সেই কবিতাটি এখানে উপস'াপন করতে চাই। কবিতাটির নাম দিয়েছি “আবার ফিরে যাওয়া”।
চার বছরের ব্যবধান
আবার সেখানে ফিরে যাওয়া
ফিরে পাওয়া অদ্ভুত পুরস্কার
উপকারের পুরস্কার রাজত্ব দেওয়ার
পুরস্কার। একবার
দেশকে সাজানোর- গরিবকে বাঁচানোর
সমৃদ্ধি সংস্কার উন্নয়নের
পুরস্কার ভোগ করলাম
ছ’টা বছর ধরে।
ভাবলাম কি বিচিত্র এই দেশ
এখানে যেনো গড়া মূল্যহীন
ভাঙ্গায় কদর বাড়ে। বিস্মিত হলাম
কি করলাম- কি তার প্রতিদান।
ছ’বছরে রাত আর দিন
সমান কাটলো। আমার ‘বাহেরা’
আমাকে ছিনিয়ে আনলো-
চারটা বছর আগলে রাখলো
বুকের কাছে। তারপর
যার কপালে রাজটিকা তুলে দিলাম
সেই- ঠিক সেই আবার
পুরস্কার তুলে দিলো আমার হাতে-
লোহার বেড়ি- উপকারের প্রতিদান!
উপায় ছিলো না- বিচার দিলাম
মহান আল্লাহপাকের দরবারে।
সে বিচারের রায় পেতে একটু দেরি হলো।
কিন' তার আগে?
সেই কয়েক বর্গফুটের
পুরনো পরিচিত আবদ্ধ কক্ষ।
বন্দি-যন্ত্রণার দ্বিতীয়বারের
স্বাদ গ্রহণের সময় শুরু হলো।
মাঝে মাঝে মনে পড়তো
সম্রাট শাজাহানের কথা-
জাহানারাকে বলেছিলেন-
“বিয়ে করিসনি মা ভালো করেছিস।
বিয়ে করলে তোর সন-ান হতো
সেই সন-ান তোকে জেলে পুরে
রাখতো- তোমরা কেউ তোমাদের
সন-ানের মুখে অন্ন তুলে
দিয়ো না- পারলে বিষ দাও।
তা না হলে গলা টিপে
মেরে ফেলো।
প্রায় সমান কথা আমার মনেও জাগতো-
তোমরা কেউ কারো উপকার করো না-
উপকার করলে সে তোমার
পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে দেবে,
পারলে ক্ষতি করো।
কিন' আল্লাহর নির্দেশ তো তা নয়-
তার যে নির্ভুল বিচার,
আমি যে তার বিচারের রায় দেখেছি।
আজ আমি মুক্ত মানুষ। মুক্ত মনে কবিতা লিখছি। ঈদকে সামনে রেখে সব কবিরাই কবিতা লেখেন। পত্র-পত্রিকায় বর্ণাঢ্য ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয়। আমিও লিখি। সম্পাদকরা ছাপেন। এবার শুধু ভাবলাম নতুন কোনো কবিতার পটভূমি চিন-া করার আগে ঈদের কবিতার স্মৃতিমন'ন করলে কেমন হয়। কখনো কখনো পুরনো দিনের কথা ভাবতে বেশ ভালো লাগে। জীবনের স্মৃতির পাতার ভাঁজে ভাঁজে তো জমে আছে অনেক কথা। অতীতের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে কিছু তার মনে পড়ে- কিছু তার নতুন বেশে মনের মাঝে হাজির হয়। তখন হারিয়ে ফেলি বর্তমানকে, অলক্ষ্যে চলে যায় আগামীর ভাবনা, ফিরে আসে অতীত এক মনোহর বেশে। মনে হয় যে দিন চলে গেছে, সেটাই ছিলো স্বর্ণালী সময়। ফিরে পেতে মন চায় মায়ের কোলের শৈশব, চঞ্চল কৈশোর কিংবা জীবন গড়ার দুরন- রঙিন যৌবন। বিগত দিনের স্মৃতি মন'ন করে হারানো দিনগুলোকে যেমন উপভোগ করা যায়- এবার সেভাবেই মনে করার চেষ্টা করলাম বিগত ঈদের কবিতাগুলোকে। শত সমস্যার মধ্যে থাকলেও ঈদ এলে অনেক আশায় বুক বেঁধে দাঁড়াই। একবার ঈদে সেই অভিব্যক্তি ব্যক্ত করলাম যে কবিতায় তার শিরোনামও ছিলো “আশায় বুক বেঁধে থাকি”।
বদলে যাচ্ছে যেনো সবকিছু
আমি দেখছি অবাক বিস্ময়ে-
আকাশ মাটি মানুষ বদলে যাচ্ছে;
প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ স্পর্শেও
বদলের হাওয়া- পরিবর্তনের সুর।
ঋতুর চরিত্রগুলোও যেনো তাদের
পরিচ্ছদগুলোর ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছে,
শ্রাবণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় বর্ষাকে
অঝোরে ঝরায় শরৎ অকালে
ভাসায় শহর নগর বন্দর গাঁও
বিস-ীর্ণ জনপদ হাবুডুবু খায়
দুর্ভোগের সীমানা পেরিয়ে।
ভাবছি কেনো এমন হচ্ছে? কেনো
বিবর্তনের ধারা সব কিছু ওলট-পালট করে দেয়
ঋতুরানী কেনো তার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না
নিয়ে তুষ্ট নয় এখন? আগের মতো
কেনো চিনতে পারি না
বছরের ছয় খণ্ড উপাখ্যান!
আমার পারিপার্শ্বিক রূপ দেখে
আমি আঁতকে উঠি- বন্ধুকে চিনতে
ভুল করি, রূপ বদলের আতঙ্কে থাকি।
মানুষের মানবিকতা বোধের
নির্মম অবক্ষয়ের মতো-
প্রকৃতির রূপের বিবর্তন দেখতে চাই না-
সান-্বনা পেতে চাই প্রকৃতিকে দেখে।
পাখিরা পৃথিবীর সব প্রানে- বসে
গাইবে একই সুরে গান, ফুল ফুটবে
একই গন্ধ রূপ আর রং নিয়ে
নদী ছুটবে পাহাড় থেকে সাগরে
বসন- তার আপন মহিমায়
আবির্ভূত হবে শীতের আবরণ ছেড়ে!
কিন' মনে হয় সবকিছু যেনো
একে একে বদলে যাচ্ছে ঠিক মানুষের
ন্যায়-নীতি-আদর্শ বোধের মতো-
কে কার কাছ থেকে শিখছে এসব?
মানুষ না প্রকৃতি? না কি আমার সবই
চোখের ভুল- দেখার ভ্রানি-!
কোথায় মানুষের সেই সহমর্মিতা বোধ,
একে অপরের আপন হবার বাসনা
কেনো বিবর্ণ হয়ে যায়?
ভালোবাসা ভুল হয়, প্রেমের পরিণতি
কেনো যুবতীর এসিডে ঝলসানো মুখ?
রাজনীতিতে কেনো প্রতিহিংসার অনুপ্রবেশ!
এক মানুষের অলক্ষ্যে কেনো
লুকিয়ে থাকে প্রাণ-লোভী আর এক
মানুষ রূপের হায়না !
নিরপরাধ মানুষের বুক কেনো
ঝাঁঝরা হয়ে যায় ঘাতকের
বুলেটে বোমায় গ্রেনেডে!
মানুষ কেনো টুকরো টুকরো হয়?
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির নৈতিকতার বিপর্যয়ের
বিষ-বাষ্প কি ছড়িয়ে পড়েছে ঋতুতে
আকাশে বাতাসে নদীতে সমুদ্রে?
পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে কি
মানুষেরই সংক্রমিত রোগে?
তবুও এত কিছুর পরে-
একটি পবিত্র দিনকে সামনে রেখে
আশায় বুক বেঁধে রাখি-
যদি ভেদাভেদহীন আলিঙ্গনে
দু’টি বুকের ভেতর থেকে
একই সাথে একই সুরে গাঁথা
বেজে ওঠা শব্দের মিলনের মতো
আমরা সবাই মিলে থাকতে পারি
যতক্ষণ ওই সুরের স্পন্দন জেগে থাকে!
ঈদ এমনই এক সার্বজনীন ধর্মীয় উৎসব- যা মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে তোলে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয়। আনন্দ উদযাপনের মধ্য দিয়ে খোদার নৈকট্য লাভের সুযোগ আসে ঈদের মাধ্যমে। তাই ঈদকে উপলক্ষ করে যা কিছুই করা হোক না কেনো তার মধ্যে পবিত্রতার ছোঁয়া লেগে যায়। ঈদকে উপজীব্য করে কাব্য বা সাহিত্য রচনার মধ্যেও যেমন সুখ থাকে তেমনি পাওয়া যায় আনন্দ। ঈদ যেমন সার্বজনীন, বিশ্বের সব মানুষ ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে- বুকে বুকে আলিঙ্গনে হৃদয় থেকে হৃদয়ে সুদৃঢ় বন্ধনের সৃষ্টি হয়; তেমনি সাহিত্যকর্মও সার্বজনীন। বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা ধর্মের জন্য আদালা আলাদাভাবে সাহিত্য রচিত হয় না। একই কাব্য-সাহিত্য সব মানুষের জন্যই রচিত হয়। যেমন অনেক মুসলমান কবি রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে উপজীব্য করে গীত রচনা করেছেন- আবার অনেক হিন্দু কবিও কোরআনের বাণী ভিত্তি করে কবিতা লিখেছেন। কোনো লেখা যখন সুখপাঠ্য হয় বা লেখা যখন পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে তখন পাঠক আর লেখকের মধ্যে হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই অনুভূতি থেকে প্রত্যেকবার ঈদকে সামনে রেখে কিছু লেখার চেষ্টা করি। কবিতায় আমার স্বাচ্ছন্দবোধটা একটু বেশি থাকে বলে ইতিপূর্বে সে দিকেই মনোনিবেশ করেছি বেশি। মনে হয় অনেক ভাবকে মন'ন করলে যে নির্জাস বের হয়- সেটাই কবিতার একটি লাইন। যার ব্যাখ্যা করলে অনেক বিষয় বেরিয়ে আসে। এবার কবিতা লেখার আগে কিছুটা স্মৃতিচারণ করে ফেলেছি। এই বিশ্বে যার পবিত্র আগমনে আজ আমরা ঈদের আনন্দ উপভোগ করছি, সেই মহা আনন্দের জন্মদিনকে নিয়ে একবার লিখেছি-“একটি দিনের প্রতীক্ষা”।
একটি আলোকিত দিনের প্রতীক্ষায়
আমার প্রতিদিন কেটে যায় উদাসীন
পথিকের মতো পথপানে চেয়ে চেয়ে।
অন্ধকার পৃথিবীতে দিকভ্রান- দিশেহারা
মানুষের পথের দিশা পাওয়ার
যে দিনটি এসে বদলে দিলো
মানুষের দৃষ্টি- বিশ্বের মানচিত্র,
ভ্রান- ধ্যান-ধারনার বিভৎস চিত্র-
যে দিন এসে খুলে দিলো
বিশ্বাসের আলোর দুয়ার, এনে দিলো
শানি-র বার্তা, মানব জাতির মুক্তির পথ-
উন্মুক্ত করলো বেহেসে-র সিঁড়ি,
নতুন সূর্য নিয়ে এলো আসমানে
জমিনে ফুটলো সুরভিত ফুল
ক্ষেত বিলিয়ে দিলো বৃক্ষ-শস্য-ফল
নদী ধারন করলো পিপাসার পানি।
যে দিনে মুক্তিদাতার আগমনী বার্তা পেয়ে
পাখি গেয়ে উঠলো খুশির গান-
সে দিনের নাম বারই রবিউল আউয়াল
মাটির বুকে এক মহা নক্ষত্রের জন্মক্ষন-
ধরায় সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ দান
অতীত বর্তমান ভবিষ্যতে তুলনাহীন
এক অদ্বিতীয় মহামানব রাসুল (সাঃ),
যার নাম আমার অন-রের
সর্বশ্রেষ্ঠ ধন- প্রানের সঞ্চালন, শ্রেষ্ঠতম অর্জন
মানবজাতির জন্য করুনাময়ের শ্রেষ্ঠতম উপহার
তাঁর জন্মদিন অনন- অসীম
প্রতীক্ষিত সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন।
তবুও এত কিছুর পরে-
একটি পবিত্র দিনকে সামনে রেখে
আশায় বুক বেঁধে রাখি-
যদি ভেদাভেদহীন আলিঙ্গনে
দু’টি বুকের ভেতর থেকে
একই সাথে একই সুরে গাঁথা
বেজে ওঠা শব্দের মিলনের মতো
আমরা সবাই মিলে থাকতে পারি
যতক্ষণ ওই সুরের স্পন্দন জেগে থাকে!
ঈদ যখন সামনে সমাগত তখন পেছনের ফেলে আসা কিছু বেদনাময় স্মৃতিও বেশ তাড়া করে যাচ্ছে। তা হলো দেশের পরিসি'তি। বারে বারে মনের মাঝে ভেসে উঠছে আসন্ন ঈদ আমরা কীভাবে উদযাপন করতে পারবো! আবার কোনো বিপর্যয় জাতিকে আতঙ্কগ্রস- করে তুলবে না তো! আসলে জাতি হিসেবে আমরাতো দুঃখ সওয়া জাতিতে পরিণত হয়ে গেছি। যেমন কথায় বলেন- “অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর”। আমাদের অবস'া হয়ে গেছে তেমন। আমরা আর কাতর হই না- এখন পাথর হয়ে গেছি। দুঃখই এখন এই পাথরের ওপর আছাড় খেয়ে আহত হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে অশানি--দুঃখ-বেদনা-অসম্মান-অপমানের পাহাড়। আমরা ব্যর্থ-অকার্যকর-সন্ত্রাসী জাতি হিসেবে পরিচিত হ্চ্িছ। বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলার ঘটনায় গোটা জাতি ন-ম্ভিত হয়ে পড়েছে। সকল দিক থেকে দেশ স'বির হয়ে পড়ছে। সেই পরিবেশের মধ্যেই ঈদ আসছে। কিন' ঈদ এমন এক বিষয় তাকে কোনো বিরূপ পরিবেশ স্পর্শ করতে পারে না। সে শাশ্বত আনন্দ। তাকে আমরা বরণ করবো হৃদয়ের পবিত্রতা উজাড় করে- সকল দুঃখ ব্যথা ভুলে গিয়ে। একটি পবিত্র দিনকে সামনে রেখে এই প্রার্থনাই করবো- ধুয়ে যাক- মুছে যাক অতীত দিনের সকল দুঃখ-গ্লানি-ব্যথা-বেদনার রাশি। ঈদের মহিমায় সিক্ত হয়ে গোটা জাতি যেন বুক বেঁধে দাঁড়াতে পারি আগামীর সোনালি দিন গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। খোদা যেনো কবুল করেন আমাদের মনের পবিত্র বাসনা।