
বন্ধু কী? সে সম্পর্কে এরিস্টটল বলেছেন, দু’টি দেহের মধ্যে অভিন্ন একটি হৃদয় হচ্ছে বন্ধু। আবার আর এক মনীষী বলেছেন, সবাই বন্ধু হয় না- কেউ কেউ বন্ধু হয়। আসলেই দু’জন মানুষের মধ্যে যখন অভিন্ন একটি হৃদয় গড়ে ওঠে- তখনই সেই হৃদয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। আমার তেমনই এক বন্ধু কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের বয়সটা খুব বেশি আগের নয়। বাল্য কিংবা কৈশোর, এমনকি যৌবনেরও নয়। যৌবন হলো বন্ধুত্ব গড়ার উপযুক্ত সময়। ওই সময়ে একটি হৃদয় আর একটি হৃদয়কে কাছে টানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বেশি বন্ধুত্ব হয় শিক্ষা জীবনে। সেটাই যৌবনের কাল। সেই যৌবনে ফজলের সাথে আমার দেখাও হয়নি। হয়তো মনের অজানে- যুগ যুগ ধরে আমি পথ হেঁটেছি একজন ফজল শাহাবুদ্দীনকে বন্ধু হিসেবে পাবার জন্য। পেয়েছি তাকে পৌঢ় বয়সে। যখন ওকে পেয়েছি তখনই মনে হয়েছে ফজলের সাথে আমার এই মাত্র পরিচয় নয়, এ যেনো অনেক সুদূরের পরিচয়। আমরা দু’জনে পথ হেঁটেছি দুই পথে- একটি গন-ব্যে পৌঁছার লক্ষ্যে। সেই গন-ব্যস'লই হচ্ছে আমাদের বন্ধুত্ব। সে আমার সত্যিই অভিন্ন এক হৃদয় বন্ধু।
বন্ধুর কাছে বন্ধুর জন্মদিনটা একটি অন্যতম স্মরণীয় দিন। ফজলের সাথে বন্ধুত্ব হবার পর নতুন ইংরেজি বছর শুরু হলেই মনের গভীর থেকেই সাড়া দেয়- সামনে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। এই দিনটিতে ফজলকে একটি বাক্য বলার জন্য মনে যেনো আমি সারাটা বছর অপেক্ষায় থাকি। কখন বলবো- ‘হ্যাপি বার্থডে ফজল’। এই দিনে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে- হে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, তুমি কি আমার জন্য হাজারটা ফজল শাহাবুদ্দীনের জন্ম দিতে পারোনি? তাহলে যে আমার হাজারটা ফজল বন্ধু থাকতো। যদিও এসব কথা হচ্ছে কল্পনার সৃষ্টি। অবশ্য কল্পনায় বিচরণ করতে অনেকে ভালোবাসেন- আমিও বাসি। কবি তো কল্পনায়ই কবিতার জাল বোনেন। ফজল একজন দেশবরেণ্য কবি। আমিও কবিতা নিয়ে চর্চা করি। এখানে আমার সফলতা-বিফলতা কোনো মাপকাঠিতে বিচার করি না। আমি আমার সৃষ্টিকে নিয়ে উল্লাসে মেতে থাকি।
কবিতাকে আমি কতোটুকু কী দিতে পেরেছি- তা জানি না। তবে কবিতা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। যেমন কবিতা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে কবি ফজল শাহাবুদ্দীনকে। যাকে আমি হৃদয়ের বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। তখন আমি দেশের রাষ্ট্রপতি। একজন রাষ্ট্রপতি কবিতা নিয়ে ভাববেন- আমার পূর্বে তা ছিলো অবাস-ব বিষয়। কিন' আমি ভেবেছিলাম। সেটা দোষের ছিলো নাকি ভালো একটা উদ্যোগ ছিলো- তার বিচার-বিশ্লেষণ হয়তো এখন করা হবে না। কারণ এখনো আমি বেঁচে আছি। যখন থাকবো না, তখন হয়তো কোনো কবির কলমের আঁচড়ে উচ্চারিত হবে- কবিতা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের যে কোনো রন্ধ্রে প্রবেশ করতে পারে। কবিতার দ্বার সব জায়গাতে উন্মুক্ত। সে রাজআসনেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, আবার দরিদ্রের পর্ণ কুটিরেও বাসা বাঁধতে পারে। একজন ছোট্ট কবি রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করে তার কবিতাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। তাতে কবিতার মর্যাদা বেড়েছে- কবি রাষ্ট্রীয় অতিথি হবার সম্মান পেয়েছেন। এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে গিয়ে আমি যে লাভবান হয়েছি- তারই দৃষ্টান- ফজলের সাথে আমার বন্ধুত্ব।
‘বাংলাদেশ কবিতা কেন্দ্রের’ মাধ্যমে ফজল শাহাবুদ্দীনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত। ও ছিলো কবিতা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক। সেই কবিতা কেন্দ্রের উপহারই একজন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ফজল শাহাবুদ্দীন। কবিতা কেন্দ্র আজ নেই। আছে ফজলের সাথে আমার বন্ধুত্ব। সেটাই আমার অনেক বড় অর্জন। তবুও কবিতা কেন্দ্র এখনো আমাকে আবেগতাড়িত করে। এই কবিতা কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে দুইবার এশীয় কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফজল ছিলো সেই কবিতা উৎসবের প্রধান সম্পাদক। ১৯৮৭ সালে এবং ১৯৮৯ সালে এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিলো। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বরেণ্য কবিগণ এই উৎসবে যোগদান করেছিলেন। তারা আমাদের দেশের কবিতা চর্চা নিয়ে একটা সু-উচ্চ ধারণা নিয়ে গেছেন। তারা অভিভূত হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাব্য সাহিত্যের চর্চা হয়- কবিতা নিয়ে আন-র্জাতিক মানের অনুষ্ঠান হয়! উৎসবে যোগদানকারী এশীয় কবিরা বাংলাদেশের কবিদের বার্তা নিয়ে গেছেন নিজ নিজ দেশে। আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম- আমাদের শিল্প-কলা-কাব্য সংস্কৃতির অনেক উঁচুতে। আমাদের সংস্কৃতির রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস। কাব্য ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা তারই ধারাবাহিকতা বয়ে নিতে চাই। বিশ্বের অনেক দেশ আছে যারা শিল্প-অর্থনীতিতে অনেক বেশি অগ্রসর। অথচ তাদের সংস্কৃতির কোনো ইতিহাস-ঐতিহ্য নেই। এশিয়ার দুই সমৃদ্ধ দেশ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। কিন' তাদের কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস নেই। তাদের নিজস্ব ভাষায় কোনো কবিতা-কাব্য-সাহিত্য রচিত হয়নি। তাদের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে বিদেশী ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সব দিক থেকে আমরা অনেক বেশি ধনী। আমাদের নিজস্ব ভাষার সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। সেই ভাষায় কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হয়। আমাদের মুখের ভাষায় রচিত গ্রন' নোবেল পুরস্কার লাভ করে। সেই ঐতিহ্য আবহমান কাল ধরে রাখা এবং সেই ভাষার কবিতার কথা বিশ্বের দেশে দেশে পৌঁছে দেয়ার যে বাসনা আমার হৃদয়ে জাগ্রত হয়েছিলো- ফজলের মতো কবির মনে তারই সুর ঝঙ্কারিত হয়েছিলো বলেই তার একান- প্রচেষ্টায় আমরা ঢাকায় এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করতে পেরেছিলাম। এই উৎসবের সফলতার জন্য আমি আরো অনেক কবির কথা স্মরণ করি। তাদের প্রত্যেকের অবদান আমার কাছে কবিতার জগতে এক একটি ইতিহাস। সবার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই না। ফজলের জন্মদিনকে সামনে রেখে আজ শুধু তার কথাই বলবো- শুধু তাকে নিয়েই ভাববো।
মনে পড়ে- এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করেও আমি কিন' সমালোচনার জটা-জাল থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি। ফজল শাহাবুদ্দীনও নয়। ওরা ‘দালাল কবি’ আখ্যায়িত হয়েছে- আমাদেরই কিছু কবি বন্ধুর মুখে। দেশের সব কবিকে আমি এশীয় কবিতা উৎসবে সম্পৃক্ত করতে পারিনি। কবি ও কবিতাকেও রাজনীতির কুটিলতার চক্রে জড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো। যারা এশীয় কবিদের সাথে মিলিত হয়েছিলেন তাদের বলা হয়েছিলো- ‘রাজসভা কবি’। আরো অনেক নেতিবাচক বিশেষণে তাদের ভূষিত করা হয়েছিলো। আর যারা উৎসবে যোগদান করেননি তারা নিজেদের বিরোধী কবি হিসেবে পরিচিত করেছিলেন। আজ তাদের কাছে বড় জানতে ইচ্ছে করে- সেদিন এশীয় কবিতা উৎসব বর্জন করে আপনারা কতোটুকু কী অর্জন করতে পেরেছিলেন? দেশের সকল কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে চেয়ে আমি কী অন্যায় করেছিলাম? সেদিন যদি কবিতা কেন্দ্রের উৎসবকে সর্বজনীনভাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে পারতাম এবং আমার পদক্ষেপকে ধারাবাহিক জাতীয় উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হতো- তাহলে তো এখনো দুই বছর অন-র সেইভাবে উৎসব পালিত হতে পারতো। বন্ধু ফজল নিশ্চয়ই আমার মতো ব্যথিত যে- আমার পরে আর কোনো সরকার সেই ধরনের কোনো উৎসবের কথা ভাবেনি। সেদিন যেসব কবিরা কবিতা কেন্দ্রের আয়োজনের বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের উদ্যোগেও পরবর্তীতে যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোনো কবি সম্মেলন বা কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো- তাহলেও খুশি হতাম। ভাবতাম- কবিদের নিয়ে তো জাতীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে- হোক তা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, কবির মর্যাদা স্বীকৃতি পাচ্ছে- এটাই বা কম কিসে?
আমি যখন কবিতা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করি তখন আমার সুদিন ছিলো। অর্থাৎ আমি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলাম। সাধারণত বলা হয়- সুযোগ-সুবিধার লোভেই অনেকে সরকারের কাছে ঘেঁষতে চায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা হয়তো ঠিক। তবে সব ক্ষেত্রে নয়। অনেকে দেশ জাতি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কল্যাণ সাধনের জন্য সরকারের সান্নিধ্য নিয়ে কাজ করতে চান। কবিতা কেন্দ্রের সাথে জড়িত হবার মধ্যে অর্থপ্রাপ্তির কোনো যোগ ছিলো না। এখানে ছিলো শুধু কবিতার চর্চা এবং কবির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়। ফজল শাহাবুদ্দীন সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে এসেছিলেন। সে আমার বন্ধুত্বকে বরণ করেছিলো হয়তো কবিতাকে ভালোবেসেই। কারণ ও বুঝেছিলো- আমি কবিতাকে ভালো না বাসলে এসব উদ্যোগ গ্রহণ করতাম না। আর ফজল তো নামকরা কবি। একজন কবি তার কবিতাকে কতোখানি ভালোবাসেন- তা তো আমি নিজের উপলব্ধি থেকেই বুঝি। ফজল আর আমার মিলিত ভালোবাসা দিয়ে এ দেশকে কবিতার মতো ছন্দময় করে তুলতে চেয়েছিলাম। কবিতায় হয়তো পেট ভরে না- কিন' মন ভরে। কবিতায় স্বাধীনতার সুর থাকে- যা স্বাধীনতা অর্জনে প্রেরণা যোগায়। কবিতা অর্থ দিতে পারে না- কিন' একটি জাতিকে গড়ে দিতে পারে। কবিতা দেশপ্রেম শেখাতে পারে- মানুষকে বাঁচার মতো বাঁচার শিক্ষা দিতে পারে। সেই লক্ষ্যে আমরা দু’জন একত্রে কাজ শুরু করেছিলাম। ফজলের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো প্রত্যাশার চিহ্ন খুঁজে পাইনি। ওকে শুধু ভালোবাসা দিয়েছি- ও শুধু সেই ভালোবাসা আকণ্ঠ পান করেছে- আর কিছু পেতে চায়নি কখনো।
আগেই বলেছি- এক সুদিনে ফজলের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। দুর্দিনেও সে আমাকে ভোলেনি। সুদিনে আর দুর্দিনে যে সব সময় পাশে থাকে সেই তো প্রকৃত বন্ধু। এই কথাটা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করেছে ফজল শাহাবুদ্দীন। আমি যখন কারাগারে নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছি, ফজল তখন মুক্ত জীবনে। কিন' আমি বিশ্বাস করি- ওর হাত-পা হয়তো খোলা ছিলো, তবে মনটা তার বন্দি ছিলো। ওর হাতে কলম ছিলো- সেই কলম দিয়ে একজন কবিকে বন্দি রাখার তীব্র প্রতিবাদ করেছে। সেই প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে তার কবিতায়। সে একটি কবিতা লিখে পোস্টার করেছিলো। সেই কবিতায় ফজল শাহাবুদ্দীন বলেছে-
মানুষ তোমার ভালোবাসা ছিলো
ভালোবাসা ছিলো নদী
তুমি জেনেছিলে বেঁচে থাকা এক
ভালোবাসা নিরবধি
তুমি জেনেছিলে ভালোবাসা এক
আকুল আগামীকাল
ভালোবাসা এক চির বিজয়ের
হাতিয়ার সুবিশাল
ভালোবাসো তুমি স্বদেশের ডাক
ভালোবাসো বাঙলারে
তোমার হৃদয় সারা দেশ জুড়ে
তুমি আছো কারাগারে
আমার অফিস কক্ষে সেই পোস্টারটি অতি যত্নের সাথে বাঁধাই করে রেখেছি। সেই পোস্টারটি শুধু আমার দেয়ালে রাখিনি, রেখেছি আমার অন-রেও। ওটা শুধু পোস্টার নয়, বন্ধুত্বের প্রতীক। একজন কবির অবস'ান থেকে তার প্রতিবাদের দলিল। আমি মনের দামে ফজলের মন কিনেছি- হয়তো তাই ও আমাকে এরকম একটি প্রতিদান দিয়েছে। শুধু এখানেই নয়- ও আমার দুঃখের সময়ে আরো এগিয়ে এসেছে। ফজলের কবিতা আমার মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিলো- কিন' ঠিক তার চার বছর পর আবার নিষ্ঠুর প্রতিহিংসা আমাকে জেলে নিয়ে গেলো। সেবার জেলে প্রবেশের ঠিক আগের দিন নিদারুণ কঠিন সময় কাটাচ্ছিলাম। পরের দিন অদ্ধকার প্রকোষ্ঠে যেতে হবে- বন্দি যন্ত্রণা আমাকে প্রতিনিয়ত কষাঘাত করবে। মুক্ত সময়ে বসে সেই জীবনের ছবি আঁকছিলাম। বারিধারার ৮ নম্বর রোডের অফিসে বসে- আমার অবর্তমানের দলীয় কিছু কাজের বিবরণী ঠিক করে রাখছিলাম। তখন রাত প্রায় ১০টা হবে। অফিসের ২/৩ জন কর্মচারী ছাড়া আর কেউ ছিলো না আমার কাছে। এমন সময় ফজল এলো আমার মনের কষ্টের কিছু অংশ কেড়ে নিতে। আজো ভুলিনি সেই সময়টার কথা।
ফজল আর আমি পরস্পরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করি। এটা অবশ্য আমারই প্রস-াব। ওকে তখনই না করে দিয়েছি- বন্ধুত্বের মাঝে কোনো রাষ্ট্রপতি থাকতে পারে না। তাই লেখার মাঝেও কোথাও ‘আপনি’ সূচক কোনো প্রত্যয় ব্যবহার করিনি। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি যে- ফজলের মতো একজন কবি আমার বন্ধু। ও তো বাংলা ভাষার এক অমূল্য সম্পদ। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে- বাংলা ভাষা থাকবে- ততোদিনই তো ফজলের কবিতা অমর হয়ে থাকবে। কবিতায় মুসলিম কবিদের আবির্ভাব খুব বেশি সুপ্রাচীন নয়। অবশ্য মুসলমানদের বঙ্গ বিজয়ের পরই এখানে মুসলিম কৃষ্টি-কালচার গড়ে উঠতে থাকে। কবি আলাওল ও কায়কোবাদের পথ ধরেই বাংলায় মুসলিম কবিদের যাত্রা শুরু। এখন ফজল শাহাবুদ্দীনের মতো মেধাবী কবিরা বাংলার কাব্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার সংখ্যা কতো হবে? নিশ্চয়ই হাজারের অনেক ঊর্ধ্বে। আমি অবাক হই এতো অদ্ভুত কবিতা ও কী করে লেখে। ফজলের “আমার কবিতা” নামের কবিতা সমগ্র গ্রন'টির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৯৬। সেই কাব্যগ্রনে' ফজল লিখেছে, তার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র অমিত তাকে একদিন প্রশ্ন করেছে- ‘কেমন করে কবিতা লেখ তুমি?’ ওকে আমারও একই প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে- ফজল তুমি কেমন করে এত সুন্দর কবিতা লেখ? ও হয়তো উত্তর দেবে- তুমি যেভাবে লেখো, সেভাবেই। কিন' আমি যে জানি একজনের ভাব আর একজনের মতো হতে পারে না। ওর লেখার ভাবটা আমার জানতে বড় ইচ্ছা হয়।
ফজলের জন্মদিনকে সামনে রেখেই ওর সম্পর্কে এতো সব কথার মালা গাঁথা। একবার ওর জন্মদিন উপলক্ষে একটা কবিতা লিখেছিলাম। সেই কবিতাটি এখানে উল্লেখ করতে চাই।
কবিকে তার জন্মদিনে
একজন কবি
মানুষকে ভালোবাসা শেখায়
প্রকৃতির মধ্যে মিশে যেতে শেখায়।
একজন কবি
জীবন জগত অনুভূতি আবেদনে
আগ্রহী হতে সাহায্য করে। নিয়ে যায়
হাসি-কান্নার গভীরতায়।
একজন কবি
প্রেম ভালোবাসার বাণী
অন-রে ধরে রাখতে সাহায্য করে।
একজন কবি
ফুল পাখি গান ক্ষেত ফসল
চেনাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
একজন কবি
ঘৃণার বদলে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায়
সাহায্য করে যুদ্ধের জায়গায়
শানি- প্রতিষ্ঠার প্রেরণা যোগায়।
হে কবি তোমার জন্মদিনে
তোমাকে নতুন করে আবিষ্কার করি-
তোমার মাঝে খুঁজে পাই প্রেম প্রীতি ভালোবাসা
জীবন-জগত অনন- অসীম,
তুমি ভালো থেকো- ভালোবাসা দিয়ে
আমাদের ভরিয়ে রাখো।
ফজলের জন্মদিনে ওর লেখা একটি কবিতা উদ্ধৃত না করে পারছি না। জন্মদিন নিয়ে ওর লেখা সেই কবিতাটি আমার ভালো লাগা কবিতার মধ্যে অন্যতম একটি। সেই কবিতার শিরোনাম ‘আমার ত্রিশলক্ষতম জন্মদিন’। অনেক দীর্ঘ সেই কবিতার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করতে চাই।
‘আজ আমার ত্রিশলক্ষতম জন্মদিন।
আমি আজো বেঁচে আছি
এবং বেঁচে থাকবো চিরকাল।
কেননা, আমার একমাত্র মৃত্যুকে
আমি অতিক্রম ক’রে এসেছি দীর্ঘদিন
শত শত বছর আগে, হাজার হাজার বছর আগে।
সেই মৃত্যুকে আমি অতিক্রম ক’রে এসেছি
বহুদিন বহু শতাব্দী আগে
যে মৃত্যু আমার শরীরকে আলাদা করেছে
আমার চিরদিনের জাগতিক অসি-ত্ব থেকে
যে মৃত্যু কেড়ে নিয়েছে আমার রক্তমাংসের
নিয়ত প্রবল চিৎকার
যে মৃত্যু আমার ক্ষুধাকে হরণ করেছে
আমার তৃষ্ণা আমার কাম
আমার যৌবন আমার বার্ধক্যকে দিয়েছে
এক অবিনশ্বর সমাপ্তি
আমি সেই মৃত্যুকে অতিক্রম ক’রে এসেছি
দীর্ঘদিন
আমার একমাত্র রক্তমাংসময় মৃত্যু
আমার একান- আত্মীয় পরিজন বেষ্টিত মৃত্যু
আমার অবিশ্বাস্য বেদনাভারাক্রান- মৃত্যু
দীর্ঘকাল গত
আজ আমার ত্রিশলক্ষতম জন্মদিন
আমি আজো বেঁচে আছি
এবং বেঁচে থাকবো চিরকাল
পৃথিবীর মৃত্যুকে অতিক্রম ক’রে . . .’
ফজল যে ভাব নিয়ে এই কবিতাটি লিখেছে তার গভীরে আমি যেতে চাই না। আমি সহজ ভাষায় বুঝতে চাই-ফজলের জন্মদিনের কথা। ‘ত্রিশ লাখ’ শব্দটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি প্রবাদ প্রবচনে পরিণত হয়েছে। আমার কাছে ফজলের জন্মদিনটাও একটি প্রবাদ দিবসের মতো। আমার কামনা- ৪ ফেব্রুয়ারিকে পরিচয় করিয়ে দেবে ফজলের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার চরল এখানে স্মরণ করি- ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসে আমার কবিতাখানি......’। আমি আজ সেইভাবে চেয়ে আছি এখন থেকে শতবর্ষ সামনে একটি ৪ঠা ফেব্রুয়ারির দিকে- সেদিন যেনো এদেশের কবিতাপ্রেমীরা পালন করে আমার বন্ধু কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের আড়ম্বরপূর্ণ জন্মদিন।