
ফেব্রুয়ারি এলেই যেনো হৃদয়ের অন-ঃস'লে সুপ্ত যন্ত্রণাগুলো আবার নড়েচড়ে ওঠে। শুরু হয় রক্তক্ষরণ। স্বজন হারানো শোকবহ স্মৃতিগুলো জীবন- হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারিতো আমাদের ভাষার মাস। এ মাসে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার যন্ত্রণা আছে- আবার বিজয় অর্জনের উচ্ছ্বাসও আছে। ঔপনিবেশিক আমলের এই ইতিহাসকে আমরা গৌরবের ইতিহাস হিসেবে বুকে ধারণ করে আছি। কিন' সেই মহান মাসটিতে আমরা একটি কলঙ্কিত দিন পেয়ে যাবো তা-কি কোনো দিনও ভাবতে পেরেছি! হায় ফেব্রুয়ারি! তোমার পাতায় যুক্ত হলো এমন একটি অভিশপ্ত তারিখ, যে তারিখটিকে এই জাতির পালন করতে হবে ভয়াবহ শোকের দিবস হিসেবে। এখানে শুধু শোক আছে- দেশের গর্বিত সন-ান হারানোর যন্ত্রণা আছে- নৃশংসতার ক্ষতচিহ্ন আছে- আর আছে সীমাহীন কলঙ্ক। এর কোনোটাই কখনো মুছে যাওয়ার নয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে বয়ে বেরাতে হবে- এইসব নিষ্ঠুর স্মৃতি।
২০০৯-এর ফেব্রুয়াতিে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহকে কোন ভাষায় বর্ণনা করবো বুঝে উঠতে পারি না-। যারা ঘটিয়েছিলো সেই নিষ্ঠুরতা- তাদের কোন ভাষায় ঘৃণা করবো! ঘাতক বলবো, না-কি পিশাচ বলবো! তারা কি মানুষরূপী পশু, না তার চেয়েও নীচু। পশুতো এত খারাপ কাজ করে না। মানুষরূপীরা যত খারাপ কাজ করতে পারে- আর কোনো প্রাণী তা পারে না। তাই আমি আজীবন বলে যাবো- ২৫ ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় যা ঘটেছে- বা যারা ঘটিয়েছে, তাদের প্রতি আমার ঘৃণা- এ দেশবাসীর ঘৃণা অনন-কাল ধরেই থেকে যাবে।
সেই কুখ্যাত বিডিআর বিদ্রোহের এক বছর গত হয়ে গেলো। ২৫ শে ফেব্রুয়ারির পিলখানায় ঘটে যাওয়া ঘটনা বিশ্বের আর কোনো বর্বরতা, আর কোনো নৃশংসতার সাথে তুলনা করা যাবে কি-না আমার জানা নেই। জানতে চাইও না। কলঙ্কের অধ্যায় ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়াই শ্রেয়। কিন' আমরা পিলখানা ট্র্যাজেডির কথা ভুলবো কি করে। আমরা যে সন-ানদের হারিয়েছি, সেই ক্ষতিতো কোনো দিন পূরণ হওয়ার নয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। নয় মাস ধরে তারা যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তারাই নেতৃত্ব দিয়েছে। সকল সেক্টর কমান্ডাররা ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে বেশ কয়েকজন সেনা অফিসার শহীদ হয়েছেন। কিন' পিলখানায় এক দিনে স্বাধীনতাযুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি সেনা অফিসার শহীদ হয়েছে। এই দুঃখ কি জাতি কোনো দিন ভুলতে পারবে? আমরা তাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখাতে পারব- সেল্যুট করতে পারব-তাদের স্মরণে মোমের আলো জ্বালাতে পারব, তাদের কবর ফুলে ফুলে ঢেকে দিতে পারব- শোক সভা, শোক মিছিল করতে পারব। কিন' যে মা-বাবা তার সন-ান হারিয়েছে, যে সন-ান তার বাবাকে হারিয়েছে, যে তার ভাইকে হারিয়েছে, যে স্ত্রী তার স্বামীকে হারিয়েছে সেই ব্যথা ঢাকব কি করে?
গত বছরের ২৫ আর ২৬ ফেব্রুয়ারি- এই দুটো দিন আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিসহ দিনের বেদনাময় স্মৃতি হয়ে রয়েছে। এখনো ভুলতে পারিনা সে সময়ের দুর্বিসহ ঘটনার কথা। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের খবর যখন প্রথম পেলাম-তখন এটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করেছিলাম। সময় যত গড়াতে থাকে ততই ভয়াবহ খবর আসতে থাকে। মনের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। ২৫ শে ফেব্রুয়ারির সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছি টিভির সামনে বসে। তখন পুরো খবর না পেলেও বুঝতে বাকি ছিলো না যে, ভয়াবহ নৃশংসতার ঘটনা ঘটে গেছে পিলখানায়। তার- মাত্রা কতটুকু সেটা নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম।
২৫ ফেব্রুয়ারির রাত যেনো আর ভোর হচ্ছিলো না। অজানা আতঙ্ক-আশঙ্কার মধ্যে সময় কাটাতে কাটাতে রাত যখন একটু পরিস্কার হয়ে এসেছে- তখনই ছুটলাম পিলখানার দিকে। বিডিআর গেটে পৌঁছে মনে হয়েছিলো- দেয়ালের একপাশে মৃত্যুর উপত্যকা আর একপাশে আমরা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার যন্ত্রণা নিয়ে অপেক্ষা করছি-কখন থামবে গুলির শব্দ। কতগুলো জীবন আমরা হারালাম, কতগুলো জীবন মৃত্যুর প্রহর গুণছে-সেই আশঙ্কায় কিংকতর্ববিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
অদ্ভুত ঘটনা আরো কিছু দেখেছি। ভিতরে যখন বিপদগামী বিডিআর জওয়ানরা দেশের মূল্যবান সন-ানদের হত্যার খেলায় মাতোয়ারা- তখন বাইরে একদল লোক খুনিদের সমর্থনে মিছিল করে। কারা এরা- কি তাদের পরিচয়, এক বছর পার হয়ে গেলেও এখনো তা শনাক্ত করা হয়নি। ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রায় সারাটা দিন অভ্যুক্ত অবস'ায় বিডিআর গেটে কাটিয়ে যখন চলে এলাম- তখন যেনো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস'ান করছিলাম। নিজেকে বড় অসহায় হিসেবে আবিষ্কার করলাম। মনে হচ্ছিল- যে জীবনগুলো হারালাম, সুযোগ থাকলে তাদের হয়তো বাঁচাতে পারতাম।
একজন সাবেক সেনা প্রধান হিসেবে এই ব্যর্থতাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। তখন সেনাবাহিনী আনা হয়েছিলো। কিন' তাদের দূরে দর্শকের মতো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ এই সেনাবাহিনীর উপসি'তিতেই বিদ্রোহীরা আতঙ্কিত হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
তারপর দেখেছি লাশ আর লাশ। সারি সারি লাশ। স্বজন হারানো সীমাহীন যন্ত্রণার সতূপ। আমি স-ব্ধ হলাম। রুদ্ধ হয়েছিলো আমার বাকশক্তি। স্বজন হারানোর কান্না-বিলাপ আর আহাজারিতে আমি বধির হয়ে গেছি। হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার জীবনের ছন্দ। প্রিয় মানুষ, প্রিয় আপনজন, দেশের প্রিয় সন-ান চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাওয়ার মর্মানি-কতার কি কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে!
আমার আপন ভাগনে কর্নেল কুদরত এলাহী রহমান শফিক শহীদ হলো। যাদের আমি সেনাবাহিনীতে শিশুর মতো দেখেছিলাম-যারা অনেক যত্নে লালিত-পালিত হয়ে দেশের অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছিলো- তারা চোখের সামনে বিনা কারণে শহীদ হয়ে গেল-কীভাবে ভুলব তাদের কথা, কীভাবে ভুলবে জাতি তাদের স্মৃতি! যে ভাগনে কোলে-পিঠে উঠে বড় হয়েছে- তার শবদেহ কবরে শুইয়ে দিতে হয়েছে- কীভাবে ভুলব সেই যন্ত্রণার কথা।
এখন সেই বিডিআর বিদ্রোহের বিচার চলছে। নিশ্চয় সুবিচার পাবো আশা করি। তবে সেই বিচার হোক এমন বিচার- যে বিচার দেখে যেনো ভবিষ্যতে আর কেউ কোনো দিন মানুষ হত্যার কথা ভাবতেই শিউরে ওঠে-বিপদগামী হতে তার আত্মা যেনো কেঁপে ওঠে। তাহলেই হয়তো আগামী দিনে যতবার ২৫ ফেব্রুয়ারি ফিরে আসবে- তখন শোকবহ যন্ত্রণার মধ্যেও এতটুকু শান-্বনা থাকবে যে, পিলখানার শহীদের রক্তের বিনিময়ে অন-ত নৃশংসতার অবসান ঘটেছে। শহীদের আত্মাও তাহলে শানি- পাবে।
বিডিআর বিদ্রোহের ফলে- আমরা যে ৫৭ জন অফিসারকে হারিয়েছি- তাদের অভাব কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তবে এই শোককে ধারণ করে বসে থাকলে চলবে না। শোককে শক্তিতে রূপান-রিত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে- সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। দুর্যোগে-দুর্বিপাকে, দেশ রক্ষা, সীমান- সুরক্ষায় সামরিক বাহিনীর কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। পার্বত্য অঞ্চলে শানি- রক্ষায় সেনাবাহিনীর অবদানকে ভুলে গেলে চলবে না। সেখানে এখনো সেনাবাহিনীর উপসি'তির প্রয়োজন আছে। আমরা কোনোভাবেই বিচ্ছিন্নতাবাদকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দিতে পারি না। আমরা কখনোই সামপ্রদায়িকতা কিংবা ধর্মে-বর্ণে, গোত্রে বা জাতিগত বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দিতে পারি না। এসব সুরক্ষার জন্যেও শক্তিশালী এবং সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী অপরিহার্য। বিডিআর বিদ্রোহের ফলে সেনাবাহিনীতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করতে হলে দ্রুততার সাথে সেনা অফিসার নিয়োগ করতে হবে। বিডিআরকে আরো সুসংগঠিত করতে হবে। আমার আরো একটি প্রস-াব থাকবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেনো কোনোভাবে সেনা প্রত্যাহার করা না হয়। তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা একের পর এক ঘটতেই থাকবে। বিডিআর বিদ্রোহে যে সেনা কর্মকর্তারা জীবন দিয়েছে- তারা দেশের কাজে নিয়োজিত থাকা অবস'াতেই শহীদ হয়েছে। দেশকে সর্বোতভাবে সুরক্ষা করেই তাদের সেই রক্তের মূল্য দিতে হবে।